আর নয় এপ্রিল ফুল; সময় এসেছে সচেতন হওয়ার

ইউরোপে মুসলমানরা প্রবেশ করেছিলেন স্পেনের দরজা দিয়ে। ঐতিহাসিক রবার্ট ব্রিফল্ট দি ম্যাকিং অব হিউম্যানিটি গ্রন্থে মুসলমানদের এ প্রবেশকে অন্ধকার কক্ষের দরজা দিয়ে সূর্যের আলোর প্রবেশ বলে অভিহিত করেছেন। কেন এই তুলনা? রবার্ট ব্রিফল্টের জবাব হলো—‘যেহেতু স্পেনে মুসলমানদের আগমনের ফলে শুধু স্পেন নয়, বরং গোটা ইউরোপ মুক্তির পথ পেয়েছিল এজ অব ডার্কনেস তথা হাজার বছরের অন্ধকার থেকে। এজ অব ডার্কনেস সম্পর্কে রবার্ট ব্রিফল্টের মন্তব্য হলো—‘সেই সময় জীবন্ত অবস্থায় মানুষ অমানুষিকতার অধীন ছিল, মৃত্যুর পর অনন্ত নরকবাসের জন্য নির্ধারিত ছিল।’

স্পেন জয়ের ঘটনাটি ঘটে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদ ভূমধ্যসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা পাড়ি দিয়ে ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে রাজা রডরিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। রাজা রডারকের শাসনামল ছিল স্পেনের জন্যে এক দুঃস্বপ্নের কাল। জনগণ ছিল রডারিক ও গথ সম্প্রদায়ের উত্পীড়নের অসহায় শিকার। মরণের আগে স্বাধীনতা ভোগের কোনো আশা তাদের ছিল না। তারেকের অভিযানের ফলে মুক্তির পথ বেরুবে, এই ছিল সাধারণ মানুষের ভাবনা। তারা তারেক বিন জিয়াদকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করল ৩০ এপ্রিল, ৭১১ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার।
 রডারক পলায়নের সময় নিমজ্জিত হয়ে মারা যায় গুয়াডেল কুইভারের পানিতে। এরপর জনগণের সহযোগিতায় মুসলমানরা একে একে অধিকার করলেন মালাগা, গ্রানাডা, কর্ডোভা। অল্পদিনেই অধিকৃত হলো থিয়োডমির শাসিত সমগ্র আলজিরিয়াস। এদিকে আরেক সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর পূর্বদিকের সমুদ্র পথ ধরে ৭১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে আবিষ্কার করেন সেভিল ও মেরিজ। তিনিও স্পেনের বিভিন্ন শহর অধিকার করে টলেডোতে গিয়ে মিলিত হলেন তারিকের সঙ্গে। তারপর তারা এগিয়ে যান আরাগনের দিকে। জয় করেন সারাগোসা, টারাগোনা, বার্সিলোনা এবং পিরেনিজ পর্বতমালা পর্যন্ত গোটা স্পেন।

তারপর মুসা বিন নুসাইর পিরিনিজ পর্বতে দাঁড়িয়ে সমগ্র ইউরোপ জয়ের স্বপ্ন আঁকছিলেন আর স্পেন থেকে বিতাড়িত গথ সম্প্রদায়ের নেতারা পিরিনিজের ওপারে স্পেন পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা আঁটছিলেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ইউরোপের খ্রিস্টান নেতারা। মুসলমানরা পিরেনিজ অতিক্রম করে ফ্রান্সের অনেক এলাকা জয় করেন। কিন্তু অ্যাকুইটেনের রাজধানী টুলুর যুদ্ধে ভয়াবহতার সম্মুখীন হয়ে তারা বুঝতে পারলেন যে, অসির পরিবর্তে মসির যুদ্ধের মাধ্যমেই ইউরোপ জয় করা সহজতর। এরপর মুসলমানদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও বিস্তারে।
 তারা সেই যুদ্ধে সফল হন এবং প্রণিধানযোগ্য ইতিহাস তাদের বিজয়কে স্বীকৃতি দিয়েছে। অপরদিকে খ্রিস্টীয় শক্তি পুরনো পথ ধরেই হাঁটতে থাকে। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মে মাসারার যুদ্ধের পর থেকে স্পেনের ওপর তাদের নানামুখী আগ্রাসন ও সন্ত্রাস চলতে থাকে। ফলে স্পেনের নিরাপত্তা হয়ে পড়ে হুমকির সম্মুখীন। 
কিন্তু স্পেনের ভেতরে পচন ধরার প্রাথমিক সূত্রগুলো তৈরি হচ্ছিল ধীরে ধীরে। সমাজের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক বোধ ও সচেতনতা ধীরে ধীরে হারাতে শুরু করছিল। রাজনৈতিক নেতৃবর্গ রাষ্ট্রের শত্রু-মিত্র বিভাজনের কাণ্ডজ্ঞান থেকে সরে আসছিল দূরে। এদিকে ইউরোপের আকাশে ক্রুসেডের গর্জন শোনা যাচ্ছে। স্পেনের বিরুদ্ধে যে আক্রোশ কাজ করছিল সেটাই তিনশ’ বছরে পরিপুষ্ট হয়ে ১০৯৭ সালে গোটা ইসলামী দুনিয়ার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে ভয়াবহ তুফানের মতো। ১০৯৮-এর জুনে এন্টিয়ক দখলের সাফল্যজনক কিন্তু নৃশংস ঘটনার মধ্য দিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠা এ তুফান ১২৫০ সালে অষ্টম ক্রুসেডের পরিসমাপ্তির পর স্পেনের দিকে মোড় ঘোরায়। স্পেনে তখন সামাজিক সংহতি ভঙ্গুর। খ্রিস্টান গোয়েন্দারা ইসলাম ধর্ম শিখে আলেম লেবাসে বিভিন্ন মসজিদে ইমামতিও করছে। তাদের কাজ ছিলো স্পেনের সমাজ জীবনকে অস্থিতিশীল ও শতচ্ছিন্ন করে তোলা।

১৪৬৯ সালে ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলা স্পেনে মুসলিম সভ্যতার অস্তিত্বকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য পরস্পর বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৪৮৩ সালে ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলা একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী পাঠান মালাগা প্রদেশে। যাদের প্রতি হুকুম ছিল শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দেয়া, জলপাই ও দ্রাক্ষা গাছ কেটে ফেলা, সমৃদ্ধিশালী গ্রাম ধ্বংস করা, গবাদিপশু তুলে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। সেই সময় মৃত্যু ঘটে স্পেনের শাসক আবুল হাসান আলীর। শাসক হন আজজাগাল। এক পর্যায়ে প্রাণরক্ষা ও নিরাপত্তার অঙ্গীকারের ওপর নগরীর লোকেরা আত্মসমর্পণ করলেও নগরী জয় করেই ফার্ডিনান্ড চালান গণহত্যা। দাস বানিয়ে ফেলেন জীবিত অধিবাসীদের। এরপর ফার্ডিনান্ড নতুন কোনো এলাকা বিজিত হলে বোয়াবদিলকে এর শাসক বানাবে বলে অঙ্গীকার করে। ৪ ডিসেম্বর ১৪৮৯। আক্রান্ত হয় বেজার নগরী। আজজাগাল দৃঢ়ভাবে শত্রুদের প্রতিহত করলেন। কিন্তু ফার্ডিনান্ডের কৌশলে খাদ্যাভাব ঘটে শহরে। ফলে শহরের অধিবাসী নিরাপত্তা ও প্রাণরক্ষার শর্তে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তাদের ওপর চলে নৃশংস নির্মমতা। আজজাগাল রুখে দাঁড়ালে তাকে কারাগারে পাঠানো হয় এবং পরে করা হয় আফ্রিকায় নির্বাসিত।

ডিসেম্বর ১৪৯১-এ গ্রানাডার আত্মসমর্পণের শর্ত নির্ধারিত হলো। বলা হলো : ‘ছোট-বড় সব মুসলমানের জীবনের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে। তাদের মুক্তভাবে ধর্ম-কর্ম করতে দেয়া হবে। তাদের মসজিদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অক্ষত থাকবে। তাদের আদবকায়দা, আচার-ব্যবহার, রাজনীতি, ভাষা ও পোশাক-পরিচ্ছদ অব্যাহত থাকবে। তাদের নিজেদের আইনকানুন অনুযায়ী তাদের প্রশাসকরা তাদের শাসন করবেন …।’ আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেন মুসা বিন আকিল। তিনি বললেন, গ্রানাডাবাসী! এটা একটা প্রতারণা। আমাদের অঙ্গারে পরিণত করার জ্বালানি কাঠ হচ্ছে এ অঙ্গীকার। সুতরাং প্রতিরোধ! প্রতিরোধ!! কিন্তু গ্রানাডার দিন শেষ হয়ে আসছিল। ১৪৯২ সালে গ্রানাডাবাসী আত্মসমর্পণ করল।

রানী ইসাবেলা ও ফার্ডিনান্ডের মধ্যে শুরু হলো চুক্তি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা। চারদিকে চলছিল ভয়াবহ নির্যাতন। পাইকারি হারে হত্যা বর্বরতার নির্মম শিকার হতে থাকলেন অসংখ্য মুসলমান। স্পেনের গ্রাম ও উপত্যকাগুলো পরিণত হয় মানুষের কসাইখানায়। যেসব মানুষ পর্বতগুহায় আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরও মেরে ফেলা হলো আগুনের ধোঁয়া দিয়ে। পহেলা এপ্রিল, ১৪৯২। ফার্ডিনান্ড ঘোষণা করলেন, যেসব মুসলমান গ্রানাডার মসজিদগুলোতে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ। লাখ লাখ মুসলমান আশ্রয় নিলেন মসজিদগুলোতে। ফার্ডিনান্ডের লোকেরা সবগুলো মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিল। তিনদিন পর্যন্ত চললো হত্যার উত্সব। ফার্ডিনান্ড লাশপোড়া গন্ধে অভিভূত হয়ে হাসলেন। বললেন, হায় মুসলমান! তোমরা হলে এপ্রিলের বোকা (এপ্রিল ফুল)।

এই গণহত্যার পরও যেসব মুসলমান আন্দালুসিয়ায় রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ফার্ডিনান্ডের ছেলে তৃতীয় ফিলিপ সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় সমুদ্রপথে নির্বাসিত করেন। তাদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখেরও বেশি। ইতিহাস বলে, তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক লোকই জীবিত ছিলেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ সমুদ্রের গহিন অতলে হারিয়ে যান চিরদিনের জন্য। এভাবেই মুসলিম আন্দালুসিয়া আধুনিক স্পেনের জন্ম দিয়ে ইতিহাসের দুঃখ হয়ে বেঁচে আছে। সেই বেঁচে থাকা বোয়াবদিলদের বিরুদ্ধে ধিক্কাররূপে ফার্ডিনান্ডের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদরূপে।

দুনিয়ার ইতিহাস কী আর কোনো আন্দালুসিয়ার নির্মম ট্রাজেডির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল? সম্ভবত হয়নি এবং হতে চায় না কখনও। স্পেন হয়ে আছে মুসলিম উম্মাহর শোকের স্মারক। পহেলা এপ্রিল আসে সেই শোকের মাতম বুকে নিয়ে। শোকের এই হৃদয়ভাঙা প্রেক্ষাপটে মুসলিম জাহানের জনপদে জনপদে আন্দালুসিয়ার নির্মমতার কালো মেঘ আবারও ছায়া ফেলছে। এশিয়া-আফ্রিকাসহ সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে মুসলিম নামধারী একশ্রেণীর বিশ্বাসঘাতক বোয়াবদিল এবং ক্রুসেডীয় উন্মত্ততার প্রতিভূ ফার্ডিনান্ডদের যোগসাজশ। আন্দালুসিয়ার মুসলমানদের করুণ পরিণতি যেন ধেয়ে আসতে চায় এই মানচিত্রের আকাশেও। এ জন্য পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিপর্যয়ের প্রলয়বাদ্য চলছে।

[তথ্যসূত্র : সৈয়দ আমীর আলী : দ্য স্পিরিট অব ইসলাম অ্যান্ড সারাসিল, সম্পাদনা-মাসউদ হাসয়ান, স্পেনে মুসলিম কীর্তি—এমদাদ আলী, ইউরোপে ইসলাম—তালিবুল হাশেমী, অনুবাদ—আমীনুর রশীদ।]

LikeShow more react

No comments:

Post a Comment

Plz spread this word to your friends