আমাদের অনুভূতিহীনতার গল্প


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

খুব ঠাণ্ডা পড়েছে, বাইরে জিরো ডিগ্রি সেলসিয়াস! কোনো গল্প বলছি না। লন্ডনে এখন শীতকাল চলছে। ৪টা বাজতেই মাগরিব হয়। ৭টার দিকে বাসায় ফিরছিলাম যখন, রাস্তার আলো গুলো বাদ দিলে আঁধার রাত। অন্ধকার রাতের বরফশীতল বাতাসের মধ্যে বাইরে এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হয়। কিছুক্ষণ থাকলে চোখ-মুখ জমে বরফ হয়। দ্রুতপায়ে কিছুদূর হেঁটে বাস স্টেশনে আসলাম। ডিজিটাল নোটিস বোর্ডে দেখতে পেলাম ৩ মিনিট পরে বাস আসবে। কোনরকম কুঁচকে-মুচকে দাঁড়িয়ে ছিলাম! উহ্‌ যা ঠাণ্ডা! স্টেশনে আর একজন মাত্র আছে, বাসের অপেক্ষা করছে। বাস এলো। আরো কিছু যাত্রী আশেপাশের অন্ধকার থেকে উদয় হলো। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে জলদি বাসে উঠে পড়লাম। উষ্ণতা খুঁজতে যেয়ে অটোমেটিক ভিতরে চলে গেলাম। দেখলাম আমার সাথে যে দাঁড়িয়ে ছিল সে বাস ড্রাইভারকে বারবার একই প্রশ্ন করছে ‘ওয়াটনি মার্কেট কোথায়?’  ছেলেটার বয়স হবে দশ-এগারো। স্কুল ব্যাগ কাঁধে ছিল বোধ হয়। এক নজর দেখেছি। আবারো প্রশ্ন করলো সে, ‘এই বাস কি ওয়াটনি মার্কেট হয়ে যাবে?’  ওয়াটনি মার্কেট একটা বাস স্টপ, আমার বাসার ঠিক আগের স্টেশন। বেশ ভিতরে ছিলাম দেখে উত্তর দিতে গেলে চিৎকার করতে হতো। হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, বাস ড্রাইভার তাকে ভুল ইনফরমেশন দিয়েছে! এক সেকেন্ডের মধ্যে ছেলেটা জবুথবু হয়ে বাস থেকে নেমে বাইরের ঠাণ্ডার মধ্যে ফিরে গেল! আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি বাস ছেড়ে দিয়েছে!

নিজের মধ্যে কেমন একটা অপরাধবোধ সৃষ্টি হলো। বাচ্চা একটা ছেলে। এই ঠাণ্ডার মাঝে আমার চেয়েও আগে থেকে অপেক্ষা করছে। আমার পাক্কা মনে ছিল, পরের বাসটি আসার কথা আরো ১৫ মিনিট পরে! এতোটা সময় আবারো ওকে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? খুব খারাপ লাগলো। বেশি এই কারণে কারণ ওর প্রশ্নের উত্তরটা আমার জানা ছিল। আমিও একই দিকে যাচ্ছি। তবুও ওকে অপেক্ষা করতে হবে। মনে আসলো আমার চেয়ে আগে থেকে ছেলেটা বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে। আমার চাইতে এই বাসে ওঠার হক ওরই বেশি ছিল...। 

এসব ভাবতে ভাবতে বাস প্রায় বাসার কাছে চলে আসলো। গত পরশুরাতের ঘটনা। শুধু ঘটনা বলার জন্য আমি লিখতে বসিনি। এই ঘটনার সাথে সাথে আরো একটা কথা আমার মাথায় আঘাত করে। ভয়ংকর একটা কথা...। সেই কথা বলতেই আজকে বসা। জানিনা কতোখানি প্রকাশ করতে পারব। তার আগে আমার খুব প্রিয় একজন আপুর দেয়া স্ট্যাটাস শেয়ার করতে চাই –

“সংবেদনশীল মন থাকা একটা নেয়ামত। অন্যের কষ্ট যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন না, তার কষ্ট লাঘব করার ইচ্ছাটাও আপনার মধ্যে sincere হবে না।”

হঠাৎ সংবেদনশীলতার কথা বললাম কেন? 

উপরের সত্যি ঘটনাটা আমি যাকেই বলব, সে স্বাভাবিকভাবে দুঃখবোধ করে... না দেখা সেই ছোট্ট ছেলেটার প্রতি তাদের একরকম মায়া জন্মে! আমার যেমন শুধু মনে হয়, ‘বাচ্চাটা ঠিকমত বাস পেয়েছিল তো?’ , মনে হয়, 'ইশশ! চিৎকার করে বলতাম এটাই ঠিক বাস!' , অথচ কতোক্ষণই বা বেশি তাকে সেই শীতল বায়ুর ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে? খুব বেশি হলে এক্সট্রা আরো দশ মিনিট?


এই ছেলের চেয়ে হাজারো গুণে খারাপ অবস্থানে আছে আরো অনেকে। যাদের ঘর-বাড়ি উজাড় হয়ে যাচ্ছে... সকালে বাবা-মা-ভাইবোন-ঘর-সংসার ছিল। বিকেলে দেখবে কিচ্ছু নেই। শুধুই কিছু জঞ্জাল পড়ে আছে। ধ্বংসাবশেষ। এক মুহূর্হের মাঝে মায়া-মমতা-স্বপ্ন সব শেষ। এদের জন্য আমাদের মায়া কই...? মাথার ছাদটা উড়ে গেল, ঘরের দেয়ালগুলো পড়ে গেলো। কিসের মধ্যে বেঁচে থাকবে ওরা? খাবার নেই, পোশাক নেই, লেখাপড়া-বন্ধু তো দূরের কথা! শত্রুর হাত থেকে পালাতে যেয়ে ধুঁকে ধুঁকে কুকুরের মত জীবন পার করে দিচ্ছে এরা। এদের জন্য আমাদের কষ্ট হয়? নাহ... একটা কুকুরের জন্যেও এরচেয়ে বেশি মায়া লাগে।  কুকুরের উদাহরণ দেয়া তো কমন ডায়লগ হয়ে গেছে, এবং বেশ decent! তাই আমার এ কথা কারো গায়ে লাগবে না।


ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খাবার তুলে নেয়া মানুষটিকে আমরা হয়তো মানুষ হিসেবেও ভাবি না। তার হাত ধরতে আমাদের ঘৃণা উগলে আসবে! বাসায় কাজের লোকের জন্য যেমন আলাদা প্লেট! গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া লোকালয়ের নোংরা-বিধ্বস্ত মানুষগুলোর কথা আমরা ক’বার ভাবি? তাদের মানুষ বলেই বা ক’বার গণ্য করি?! এই সংবেদনশীলতার আজ বড় অভাব। আমরা কথার দিক থেকে রোবট হইনি। মুখে আমাদের ‘প্রে ফর গাজা’ ‘সেভ রোহিঙ্গা’ লেগে থাকে। অবশ্য মুখে লেগে থাকে না। প্রোফাইল পিকচারে ঝুলে থাকে। কিন্তু অন্তরে - গরিব, অসহায়, নির্যাতিত - তাদেরকে আমরা চিনি না! চোখের সামনে তাদেরকে দেখলে আমরা ‘না-দেখার’  ভান করি! আর চোখের আড়াল হলে তো মন থেকে একেবারে মুছেই গেল। তাই বললাম কথায় আমরা সবচেয়ে সহানুভূতিশীল হতে পারি, কিন্তু কাজে আমাদের মত নিষ্ঠুর স্বার্থপর প্রাণী খুব কমই আছে। ‘প্রাণী’ বললাম ইচ্ছে করেই। মানুষ হবার জন্য তো মানুষকে মানুষের কষ্ট বুঝতে হয়। জানোয়ারের চেয়ে নীচু মন নিয়ে তো মানুষ নামের অধিকারী হওয়া চলবে না।


যাদের কথা বললাম তারা মুসলিম উম্মাহর অংশ। উম্মাহ উম্মাহ বলে চিৎকার করি যারা, এই উম্মাহর কথা সত্যিই কতখানি ভাবি? আমাদের ভাবনাটা জুড়ে কি থাকে? উম্মাহর অনুভূতি? তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট? শীত-গ্রীষ্মের যাতনা? তাদের স্বজন হারাবার বেদনা? বুঝি আমরা সেসব? বুঝতে চাই? যদি না বুঝি, না বুঝতে চাই, আমাদের মধ্যে বিরাট সমস্যা আছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুসলিম উম্মাহ একটি শরীরের মত, এর এক অংশ আহত হলে পুরো শরীরে জ্বর এসে যায়’। [১] জ্বর আসা মানে বুঝেন?

ক’মাস আগে একবার সিস্টারদের এক কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। খিলাফত আর উম্মাহর কথা তাদের মুখে মুখে। আবেগজডড়ানো বক্তৃতা শুনে কতোজনের চোখে পানি আসল। এক বোনের চোখে কী যেন একটু হয়েছিল। সে তাঁর চোখের ব্যথায় কাতর! আশেপাশের সিস্টাররাও তাঁর চোখ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলো, বা ব্যস্ত হতে বাধ্য হলো! একে বলে ব্যথা। বার বার শুধু চোখের কথা বলে! চোখে হাত দেয়, ভাপ নেয়! অল্প একটু ব্যথায়-ও কতো অতীষ্ট হয়ে গেল একজন! উম্মাহর জন্য আমাদের এই বেদনা কোথায়? জ্বর আসলে শরীরের যে যন্ত্রণা উম্মাহর তরে সে কাতরোক্তি কোথায়? আমরা নিজেদের কিছু হলে তো আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই... আমাদের এই ব্যস্ততার সাথে মুখে উম্মাহর জন্য উদ্বিগ্ন হবার আকাশ-পাতাল তফাত! এই উদ্বেগ কখনো শুধু মুখের কথায়, দুটি কনফারেন্স, একটি মিছিল, কয়টি ইসলামের সার্কেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। উম্মাহর জন্য সত্যিকার উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটবে আমাদের জীবনের প্রতিটি চিন্তায়-কথায়-কাজে। এভাবে পুরো জীবনকেই বদলে দেবে। আমরা সময় নষ্ট করব না, নিজেকে প্রতিনিয়ত উন্নত করার সংগ্রামে লিপ্ত হবো, মুসলিমকে দেখব আপন ভাই, আপন বোনের মত।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ “আর তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসীরা অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষালম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও।” [২]


***

একটা বাচ্চা বাসের জন্য অপেক্ষা করছে, ঠাণ্ডায় কাঁপছে। একটি নয়। হাজার হাজার শিশু ঠাণ্ডায় কাঁপছে, ক্ষুধায় শুষ্ক হয়ে কাতরাতে কাতরাতে মরে যাচ্ছে, নোংরা পিশাচের বিষাক্ত থাবায় মা-বাবা-ভাইকে হারাচ্ছে, হাজারো মানুষ চিৎকার করে বলছে, ‘কোথায় তোমরা? আমার মুসলিম ভাইবোনেরা? কোথায় আল্লাহর সাহায্য?’ আমরা তাদের কথা ভাবি না। তাদের জন্য অন্ধকার রাতে বাস আসে না... তারা দাঁড়িয়ে থাকে...  তারা প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে পেয়ে একাকী মারা যায়, মারা যাচ্ছে, আমাদের চোখের সামনে, মনের আড়ালে... আমরা দেখছি, শুনছি। অনুভূতিহীনভাবে।

একটা বাচ্চা পথচেয়ে তাকিয়ে থাকে। হয়তো কোনদিন মানুষের বিবেক জাগ্রত হবে... হয়তো কোনদিন মৃত মনটা আরেকবার রক্তের গন্ধ শুঁকতে পাবে... হয়তো কোনদিন মুসলিমদের মাঝে জেগে উঠবে সত্যিকার ভ্রাতৃত্ববোধ – সেই প্রতীক্ষায়...