রাষ্ট্রধর্ম!

ফিলহাল-হালচাল-সমকাল:৭২
রাষ্ট্রধর্ম!
-
বাঙলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকা না থাকার মধ্যে আদতে কোনও পার্থক্য নেই। যেহেতু এই সংবিধান কুরআনী সংবিধান নয়। কুরআনী সংবিধানের প্রধান বক্তব্যই হলো ‘হুদুদ’। বলতে গেলে তার কিছুই বাঙলাদেশী সংবিধানে নেই। ড. কামাল হোসেনরা তাদের কমিউনিস্ট ভাবধারার আলোকেই এই সংবিধান রচনা করেছেন।
-
রাষ্ট্রধর্ম হিশেবে ইসলাম থাকার কারণে, সরকার ইসলামবিরোধী কোনও আইন করতে লজ্জা পাচ্ছে, এমন নয়। তারা যখন যা ইচ্ছে আইন পাশ করেই নিচ্ছে। তাহলে তুলে দিতে চাচ্ছে কেন?
= তারা তো জানে, এমনটা করতে গেলে, তাদের ভোট কমে যাওয়ার আশংকা আছে, ইসলামবিরোধী দল হিশেবে স্থায়ী ট্যাগ লেগে যাবে! তারপরও কেন এ-ব্যাপারে উৎসাহ?
(এক) খেয়াল করলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে আবেদনকারী ১১ জনের সবাই হিন্দু। এবং প্রায় সবাই ভারতের একনিষ্ঠ এজেন্ট। এবং এরা বা এদের গুরুরাই বর্তমানে বাঙলাদেশের নীতি নির্ধারক। তারা চায় ভারতের মতো এদেশও সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হোক। নামকাওয়াস্তে হলেও।
.
(দুই) বাঙলাদেশের প্রতিটি সেক্টরকে ‘হিন্দুয়ায়ন’ করার কাজ প্রায় সম্পন্ন। রাষ্ট্রপ্রধান-প্রধানমন্ত্রী-স্পীকার ছাড়া প্রায় সবখানেই হিন্দুদের পদায়ন সম্পন্ন। ভবিষ্যতে যাতে অবশিষ্ট পদেও নির্বিঘ্নে কাজ সারা যায়, আগাম ব্যবস্থা করে রাখা হচ্ছে।
.
(তিন) সরকারের ঝুঁকি নেয়ার কারণ হলো, বাঙলাদেশের অমুসলিম ভোটগুলোকে একশ ভাগ নিজেদের জন্যে পাকাপোক্ত করে ফেলা। ভারতের সাথে সম্পর্কটা আরও নিবিড় করা। আর নিজ দলের মুসলিম ভোটারদের নিয়ে ভাবনা কিসের! নিরপেক্ষ ভোটারদেরকে ভোলাতে বেশি কিছু লাগে?
.
(চার) ইসলামের বিধানে টুপি পরা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু বাহ্যিকভাবে প্রতীক হিশেবে টুপিটা নামাযের চেয়েও শক্তিশালী। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও। নামায তো সব সময় দেখানো যায় না। টুপি-দাড়ি-হিজাব হলো সাইনবোর্ড। সংবিধানে কী আছে না আছে, সেটা আপাতত বিবেচ্য নয়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলো টুপির মতো। প্রথমেই এটা চোখে পড়বে। টুপি খুললে যেমন মাথার টাক দেখা যায়, ইসলামকে উঠিয়ে দিলেই সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ দেখানো সহজ হয়ে যাবে। সেজন্যই এত তোড়জোড়।
.
(পাঁচ) এখন আর ব্যাপারটা রাষ্ট্রধর্ম থাকা না থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কুরআন আর বেদ-ত্রিপিটক-বাইবেলের লড়াই। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আর মুসলমানদের মর্যাদার প্রতীকি লড়াই।
.
(ছয়) আরও একটা ভয়ংকর বিষয়ও থাকতে পারে: মুসলমানরা এখন রাষ্ট্রধর্মের জন্যে লড়াই করছে। তার মানে মুসলমানরা এই সংবিধানকে মেনে নিচ্ছে বা সন্তুষ্ট থাকছে। অর্থাৎ মুসলমানদের জন্যে এমন সংবিধান থাকতে পারে। চলতে পারে। একটা মানবরচিত বিধান মুসলমানদের সংবিধান হতে পারে। শুধু রাষ্ট্রধর্মের মোড়কে ইসলামের টুপিটা পরিয়ে রাখলেই হলো।
.
(সাত) এটা ঠিক, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখার সংগ্রাম করার অর্থ এই নয়, সংবিধানকে মুসলমানদের জন্যে উপযোগী হিশেবে মেনে নেয়া হয়ে যাবে। কিন্তু এটুকু তো হবে, রাষ্ট্রধর্ম বহাল থাকলে মানুষ খুশিমনে চুপ হয়ে যাবে। প্রকারান্তরে ওটাও তাদের একটা সফলতা।
.
(আট) ধরা যাক, রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা হলো। তখন? হুযুররা আন্দোলনে নামবে! আন্দোলনটা কিসের জন্যে হবে? নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা নিয়ে!
তারমানে যাদের মেহনত করার কথা ছিল পুরো সংবিধানটাকেই বদলে সেখানে কুরআনকে বসানোর ব্যাপারে, আজ তাদেরকে নামাতে নামাতে একটা ‘খোসা’ পর্যন্ত নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
.
(নয়) এই যে পুরো দাবি থেকে ছাড়িয়ে শুধু ‘নামকাওয়াস্তে’ পর্যন্ত এনেছে, এটা করতে সময় লেগেছে দুই প্রজন্ম। আগামী এক প্রজন্ম পর কেমন হবে? তখন হুযুররা নামকাওয়াস্তের জন্যেও লড়বে না। এখানেই তাদের সফলতা।
.
(দশ) তাহলে কি আমরা চুপ থাকবো? কিছুই বলবো না?
= উঁহু সেটা বলছি না। আমরা আপাতত খোলসটুকুর জন্যেই লড়বো। পাশাপাশি আমরা আজ কোথায় নেমে এসেছি বা আমাদেরকে কোথায় নামিয়ে আনা হয়েছে, সেটার দিকেও সচেতন মনোযোগ রাখবো। আমরা শুধু নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রধর্ম নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে যাবো না।
.
(এগার) নামকাওয়াস্তে হলেও, এর মূল্যও কম নয়। এই সামান্য খোলসটুকুও কুফর-হুনুদের গায়ে জ্বালা ধরায়। কুরআন কারীম তো বলেছেই (লিয়াগীযাল কুফফার) কাফিরদেরকে যা ক্রুদ্ধ করে, সেটা করতে। শুধু এটুকু মনে রাখতে হবে, আমাদের এখানেই থেমে গেলে চলবে না। সারাক্ষণ মনে প্রশ্ন রাখতে হবে:
= আমরা কি এই সংবিধান চেয়েছিলাম? আল্লাহ এই সংবিধান চান?
.
(বারো) টুপির যথার্থ স্থান কোনটা? অবশ্যই মাথা। টুপিটাকে যদি একটা গাছের আগায় বা অন্য কোনও প্রাণীর মাথায় রাখি? সেটা হবে টুপির চরম অবমাননা। আমাদেরকে ভাবতে হবে, একটা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মাথায় ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ব্যাপারটা ‘অন্যকিছুর’ মাথায় টুপি পরিয়ে রাখার মতো হয়ে যাচ্ছে না তো!
.
(তেরো) রাষ্ট্রধর্মের জন্যে জান লড়িয়ে মেহনত করবো। কিন্তু মূল সংবিধানকে ভুলে গেলে চলবে না:
= আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী শাসন করে না, তারাই কাফের (মায়েদা: ৪৪)।
= আমরা পুরো সংবিধান (কুরআন) ছেড়ে শুধু নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রধর্মের জন্যে লড়ে, অল্পমূল্য গ্রহণ করে ফেলছি না তো!
= আর দ্বিতীয় অংশ? তারা কি আল্লাহর নাযিল করার বিধান দিয়ে শাসন করছে? যদি না করে, তাহলে তারা কী? আয়াতের অর্থ বুঝতে কি কোনও সমস্যা হয়?
.
(চৌদ্দ) আরেকটা আয়াতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেই শেষ করে দিচ্ছি:
= আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে, আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে। তারা তাগুতের কাছে বিচার (ফায়সালা) চাইতে যায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন তাকে (তাগুতকে) না মানে! (নিসা: ৬০)।
= একটা বিষয় পরিষ্কার করতে হবে: আমরা যাদের কাছে বিচারের দাবী নিয়ে যাচ্ছি, তারা তাগুত নাকি হক! কোনটা? মাঝামাঝি কোনও কিছু নেই।
.
= তারা যদি হকপক্ষীয় না হয়, তাহলে নিজেদের আকীদার দিকে চৌকান্না থাকতে হবে। আমরা রাষ্ট্রধর্মের দাবী যে করছি, সেটা তাদের কাছে আবেদন বা বিচার চাওয়ার ভঙ্গিতে নয়, তাগুতের বিরুদ্ধে লড়ছি, এই আকীদার ওপর দাঁড়িয়ে থেকে করতে হবে। না হলে কিন্তু ঈমান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে!
.
= আমরা যাই করবো, বিচার চাওয়া বা ফয়সালা চাওয়ার ভঙ্গিতে নয়, তাগুতকে বাধ্য করার ভঙ্গিতে করবো। আকীদা-নিয়তে থাকবে:
-আমরা তাগুতবিরোধী অবস্থান শুরু করেছি।
-এখানেই আমরা থেমে যাবো না।
-আমরা আপাতত দুর্বল বলেই শুরুটা নিরীহ হয়েছে হয়তো! কিন্তু ......।
-আমরা টুপির জন্যে লড়লেও, মনে রাখতে হবে, টুপির নিচে কিন্তু মুমিনের মাথা নেই, আছে তাগুতের ‘মগজ’।
-টুপি দিয়ে শুরু হয়েছে, কিন্তু মগয ঠিক না করে থেমে যাওয়া চলবে না।
.
(পনের) আবারও বলছি:
= তাগুত (গণতন্ত্র)-এর কাছে বিচার চাওয়া একপ্রকার কুফুরি।
= বিচার চাওয়ার ভঙ্গিতে নয়, ফায়সালা চাওয়ার আকীদায় নয়। তাহলে ঈমান চলে যাওয়ার সমূহ আশংকা। আমরা চূড়ান্ত লড়াই শুরু করেছি। বিচার চাওয়া নয়, আমরা জোর করে আমাদের অধিকার আদায় করছি, এই আকীদা সবসময় হাযির রাখতে হবে।
= আর টুপিটা চূড়ান্ত ‘অধিকার’ নয়। শুরু মাত্র।
= আর যে পদ্ধতিতে অধিকার আদায়ে নেমেছি, সে পদ্ধতিটা একমাত্র ও অব্যর্থ নয়। রাজপথ বা ফেসবুকও নয়। এসব সাময়িক হিশেবে চলতে পারে। কার্যকর কৌশল এটা নয়: আওর কুচ!

:: ভুল করার পর ::

সকাল থেকে একটা অনুশোচনা আর আফসোসের সূঁচ ক্রমাগত হৃদয়কে বিদ্ধ করে চলেছে। রাশেদ কী নির্বিকার চিত্তে বললো কথাগুলো, “তোমার এইসব মোরাল আর ভ্যালুজ এর কোনো দাম নেই, তুমি নিজেই এসবের দাম দাও না। শুধু সুযোগ বুঝে কাজে লাগাও.. আর আমি একদিন করতে বললেই সমস্যা।”

কীভাবে পারলো বলতে?

সাড়ে তিন বছরের সংসার। কোনোদিন কি রাশেদ মৌরিতাকে ওর হিজাব করার ব্যাপারে সাহায্য করেছে? সে নিজেই তো একা একা যতোটা পারে মেইন্টেইন করেছে বরাবর।

হ্যাঁ, বিয়ের সময় কিছুটা ছাড় সে দিয়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে তখন। হঠাৎ দেখাদেখি, দুই পক্ষের পাকা কথা, দিনক্ষণ মেলানো। চিন্তায়-ভাবনায়, চাওয়া-পাওয়ায় এত মিল সহজে পাওয়া যায় না। দুই পরিবারের সবাই রাজি, সবাই খুশি! রাশের ওই পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে আর মৌরিতা এই পরিবারের প্রথম সন্তান হওয়ায় আমোদ-আহ্লাদটা দু পক্ষেরই মাত্রাছাড়া। আর আয়োজনটাও তেমনই জমকালো, মনে রাখার মতো।

এত হুলুস্থূল বিয়েতে সবাই পরী সেজে থাকবে আর মেয়ে খালাম্মার মত ঢেকেঢুকে থাকবে তা কি হয়? মৌরিতার মা আর খালারা প্রথম থেকেই চাপাচাপি করছিল হিজাব ছাড়া থাকার জন্য। প্রথম প্রথম ওর একটুও ইচ্ছা করে নি। সারাবছর সাদাসিধে চলা মেয়ে ও, এত সাজগোজ, দেখানো স্বভাবটা অসহ্য লাগে। তাই বলে বিয়ের দিনেও এভাবে থাকবে? তোর চেয়ে তো তোর খালাকে বেশি সুন্দর লাগবে দেখতে। হিজাব করলে কি মানুষের কোনো শখ থাকতে নেই? একদিন হিজাব না করলে কী এমন হবে? কত রকম কথা। বান্ধবীরা ওভার-স্মার্টনেসের দিক থেকে আরও কয়েকশ ধাপ এগিয়ে, হিজাবের সাথে বিয়ের শাড়ি পরলে নাকি দেখতে বুড়ি-বুড়ি, আনস্মার্ট, আর গেয়ো ভুতের মত লাগবে দেখতে!

মানুষের মন বোঝা দায়। মৌরিতারও কি ছাই ইচ্ছা করেনি হিজাব-ছাড়া থাকতে? হৃদয়ের গোপন একটা প্রকোষ্ঠে ওরও এমন একটা ইচ্ছা যে হয় নি তা না। কিন্তু তবুও মনে হতো-- কাজটা ঠিক হবে না। এতদিন যে বিশ্বাস, নীতি আর আদর্শের ওপর নিজেকে অটল রেখেছে, সেখান থেকে হুট করে একদিনের জন্য সরে দাঁড়ানো একটা চরম পর্যায়ের বোকামি হবে। একদিনের জন্য হিজাবে ছাড় দেওয়াটার কোনো যুক্তিই নেই।

কিন্তু মন মানলো না। আস্তে আস্তে তার অনিচ্ছাটা দ্বিধায় পরিণত হতে থাকলো। শেষে অজান্তেই নিজের সামনে কিছু অপশন তুলে দিলো সে, নিজেকে ছাড় দেওয়া জন্য কতোগুলো অজুহাত মাত্র- বিয়ের দিন কি হিজাব করবো নাকি করবো না? শুধু স্কার্ফটা কি পরবো? আচ্ছা, যদি শাড়ির সাথে ভালো না লাগে তাহলে ছোট হাতা ব্লাউজটাই নাহয় পরবো…

বিয়ের দিন কীভাবে যেন হিজাব না করানোর জন্যই সবকিছু জোট বেধে ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগলো। ব্লাইজের কাপড়টা দিয়ে কোনোমতেই ফুল হাতা হবে না দর্জি সাফ জানিয়ে দিলো। একরঙা কাপড় এনে বড়ো হাতা ব্লাউজ বানানো যেতো, কিন্তু তখনই সব আলস্য আর উদাসিনতা পেয়ে বসলো মৌরিতার। সারাদিন বাইরে টো-টো করে ঘুরে শাশুড়ি আর ননদের সাথে মিলে এই শাড়িটা পছন্দ করে কিনেছে, তার সাথে একরঙা সাধারণ একটা কাপড়ের জোড়া দেওয়া ফুলহাতা পরলে কি মানাবে, শাশুড়িই বা কী মনে করবে? এইসব হাবিজাবি শত চিন্তা করতে করতে ছোট হাতা ব্লাউজই বানিয়ে ফেললো। এরপর ছোট হাতা ব্লাউজের সাথে মাথায় স্কার্ফ পরলে কেমন দেখাবে সেই অস্বস্তিতে স্কার্ফটাও পরলো না। বান্ধবী কেয়া নতুন নতুন ফটোগ্রাফি ক্লাবে জয়েন করেছে। তাকেই বলেছিল সুন্দর সুন্দর কয়েকটা ছবি তুলে দিতে, গ্রুপ ফটো তোলার লোকের তো অভাব নেই, স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছবিগুলো যেন কেয়াই তোলে। কিন্তু কেয়া আবার ওর ক্লাব থেকে সিনিয়র ভাইকে ধরেবেঁধে আনলো- তার ছবির হাত নাকি অসাধারণ, বলিউড ফটো আর্টিস্টও ফেইল! ব্যস, মৌরিতাও গলে গেলো। স্বামী-স্ত্রীর ছবি তো বটেই, মৌরিতার ক্লোজ শটগুলিও তিনিই নিলেন। মেইক-আপঅলা ঝিকিমিকি চেহারার ছবি, গালে হাত-কোমড়ে হাত আকাবাঁকা পোজ দেওয়া ছবি, হিজাববিহীন পোশাকের খোলামেলা ছবি…

সেই হিজাববিহীন পোজ দেওয়া ছবিগুলোর কথা ভাবতেই আজকে মৌরিতার চোখ ঠেলে একগাদা বাষ্প দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসলো। ঘেন্নায় রি-রি করছে তার মন। কার প্রতি এত ঘৃণা তার? রাশেদের কথাগুলো রিপ্লে-তে দেওয়া মিউজিকের মতো অনন্তকাল ধরে মাথার মধ্যে বেজেই যাচ্ছে। “তোমার কোনো মোরাল-টোরাল নেই, যখন ভালো লাগে করো, আর যখন ইচ্ছা খুলে ফেলো। এগুলাকে ধর্ম করা বলে না, এগুলাকে বলে সুযোগ নেওয়া। হিজাবকে এতোই ভালোবাসলে বিয়ের দিন করতা না নাকি? ফেসবুকেও তো যখন-তখন হিজাব-ছাড়া ছবি শেয়ার দিচ্ছো, এখন একটা স্পেশাল অকেশনে রিকোয়েস্ট করলাম আর তোমার দশ রকম বাহানা… একটা দিনের জন্য এখন আর হিজাব ছাড়তে পারছো না, কত বড়ো বড়ো অফিসার আসবে আজকে তাদের বউটউ নিয়ে। বিয়ের সময় হাজার হাজার মানুষের সামনে ঠিকই ফ্যাশন শো করলা, এখন একটা অকেশনের জন্য কী হয় … ”

তাই তো। রাশেদ কি খুব মিথ্যে বলেছে? বিয়ের সময় হাজার লোকের আনাগোনা, সেই দিনটাতেই তো হিজাবে থাকার দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি। সে যদি সত্যিই আল্লাহর কথা ভেবে হিজাব করতো, তাহলে কি নিজেকে এতো খেলো করে দিতে পারতো? নিজের আত্মসম্মান আর লজ্জাবোধে কি একটুও আঘাত লাগতো না? শাশুড়ির মন জয় করার ধোঁয়া তুলে নিজের ব্যক্তিত্বকেই বিলিয়ে দিলো সে। তার শাশুড়ি অতটা না-বুঝ মানুষও তো ছিল না। শিক্ষিত মেয়ে মৌরিতা, শ্বশুরবাড়ির সবাই একনজরে পছন্দ করেছে দেখে। ও অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই তারা গুরুত্ব দিতেন। সত্যি বলতে মৌরিতার এখন মনে হচ্ছে যেন তখন সে নিজের বিশ্বাসের ওপর কাজ করলেই মানুষ তাকে আরও বেশি সম্মান করতো, তার মতামত ও কথার দাম দিতো, বুঝতো যে ওর শিক্ষাটা কেবল সার্টিফিকেট সাঁটা শিক্ষা নয়, বরং মনের ভেতর থেকেই ও একজন আলোকিত মানুষ।

বিয়ের পরেও ঘোরাঘুরি করতে গিয়েও বিভিন্ন সময়ে অনেক ছাড় দিয়েছে। হানিমুনের সময় তো হিজাবের কথা মনেই ছিল না। দুই-একজন পুরোনো বান্ধবী জিজ্ঞেস করেছিল অবশ্য, দায়সারা একটা উত্তর দিয়ে মৌরিতা ওদেরকে পাশ কাটিয়েছে। “তোর চরকায় তেল দে।” কিন্তু মনে মনে ভীষণ দাগ কাটতো ওদের কথাগুলো। প্রাণপণে মাথা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতো চিন্তাটাকে, আর কদিন পরেই হিজাব করবো এই যুক্তিই নিজেকে দিতো সে বারবার। কিন্তু এখন করতে কী সমস্যা? এই প্রশ্নের জবাব কখনোই নিজের কাছে দেওয়া হয় নি।

সুযোগ আর সামর্থ্য একসাথে খুব কমই মেলে। হবু শ্বশুরবাড়িকে রাজি করানোর মত সুযোগ আর বুদ্ধি দুটোই মৌরিতার ছিল। রাশেদের পরিবার ওর কোন কথাটা রাখে নি? বিয়ের সময় যেমন যেমন কাপড়ের সেট আর গহনার ডিজাইন চেয়েছে, ঠিক সেগুলোই কিনেছে। হিজাবটা সে বিয়ের দিন করতে চাইলে সে সুযোগ নিশ্চয়ই ছিল। হয়তো একটু কাঠখড় পোড়াতে হতো, তাও তো চেষ্টা করে দেখতে দোষ ছিল না। এখন আর সেই দিনগুলো ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা নেই। সঠিক কাজটা করার সময় আগেই পার হয়ে গেছে। এখন তো প্রায় সব ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলোতেও সে হিজাব ছাড়াই চলে যায়। মানুষটা তার হিজাবের গুরুত্ব কীভাবেই বা বুঝবে? বন্ধু-বান্ধবীদের দেখাদেখি দু-চারটে ছবি মৌরিতা এখন সবার সাথে শেয়ার করে। সে সবে হিজাব নেই। এত শো-অফ করা তার ধাচে নেই, অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় সমানে-সমান কখনোই যেতে পারবে না জানে, তারপরও স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে কয়েকটা ভালো ছবি দেখাতে ইচ্ছে করে। রাশেদের খোঁচা দেওয়া কথাগুলোর সমস্ত ঝাল এখন নিজের ওপর ঝাড়তে ইচ্ছে করছে। দুঃখের ব্যাপার হলো, মানুষ নিজের ওপর রাগ ঝাড়তে পারে না।

দুঃখিনী মৌরিতা চোখে জল নিয়েই আয়নার সামনে সাজতে বসলো। মেয়েরা মনের জল গোপন করেও হাসতে পারে। আজ সন্ধ্যায় পার্টি। রাশেদের বসের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। মৌরিতা আজ হিজাব করলে রাশেদ কিছুতেই খুশি হবে না। অভ্যস্ত হাতে সব করে যাচ্ছে সে। অথচ মনটা ব্যথায় অবশ হয়ে আছে। সাড়ে তিন বছরের সংসার। রাশেদের জন্য সব করতে পারে মৌরিতা, তবু সে কি সুখী? সব ছেড়েও কি রাশেদের মন জয় করতে পেরেছে সে? রাশেদ কি তাকে একজন মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে শিখেছে?

কাজল, আইলাইনার, লিপস্টিক সব নিখুঁতভাবে হয়েছে। তার সাজার হাত চমৎকার। কিন্তু এত সেজেও কীসের যেন কমতি। আত্মগ্লানি, অনুশোচনা, লজ্জা, অপমান তাকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিচ্ছে। জানালা দিয়ে হু-হু একটা বাতাস এসে মৌরিতার আয়রন করা চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। চোখের জলে কাজল লেপটে একাকার হয়ে গেলো সাজানো চেহারা। কী মনে করে ধুম করে উঠে গেলো মৌরিতা।

মাথায় যেন কিচ্ছু নেই। একটা স্বর ভেসে ভেসে তাকে শুধু বলছে - ওয়াশরুম, ওয়াশরুম। রাশেদ খুশি হবে না জানে, তবু আজকে তাকে কাজটা করতেই হবে। বরং অনেক আগেই করা উচিত ছিল। আজ সে কোনো মেইক-আপ করবে না। পরিপূর্ণ হিজাব করবে। এখন থেকে সমস্ত অনুষ্ঠানেই সে পরিপূর্ণ হিজাব করবে। কক্ষণো আর হিজাব ছাড়ার মত ভুল করবে না। যার যা খুশি তাকে নিয়ে ভাবুক। এতদিন সংসারের জন্য অনেক করেছে, স্বামী-সংসারের বাহানা করে নিজের আত্মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর থেকে সরে গিয়েছে যোজন যোজন দূরত্বে। তাতে কোনো লাভ হয় নি। পাপের আনন্দ দুই দিনের, অনুতাপটা চিরকাল তাড়া করে ফেরে। মৌরিতার বুক চিরে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, হে আল্লাহ, অনেক ভুল করেছি। এবার আমাকে ক্ষমা করো, এবার আমায় পথ দেখাও…

কলের ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা আর চোখের উষ্ণ জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মৌরিতা, তুমি সুখী হও।

 সংকলিত লেখা
লেখক এর লিঙ্ক এখানে