আল্লাহ্‌র মনোনীত জীবন ব্যবস্থায় সুদ : পর্ব ৩ - রিবার পরিচয় ১

পর্ব ১: http://goo.gl/IhWcQi
পর্ব ২: http://goo.gl/juXI56 


আমরা গত পর্বে ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় ‘রিবা’ এর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছি। কুর'আন ও সুন্নাহ-এর অকাট্য দলীলের মাধ্যমে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, ইসলামে রিবাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো রিবার পরিচয় নিয়ে।

আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়টা জানা প্রয়োজন, তা হল ইসলামে রিবা শব্দটি একটি ব্যপক অর্থবোধক শব্দ। আমরা অনেকেই রিবা বলতে শুধু সুদ বুঝে থাকি। অর্থাৎ ইংরেজি Interest বা usury বুঝে থাকি। কিন্তু বাস্তব কথা হল রিবা শুধু সুদ শব্দে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আরো অধিক কিছুই বোঝায়। বিভিন্ন গ্রন্থে ফকীহগণ রিবা শব্দের ৫ রকম ব্যবহার উল্লেখ করেছেন।


  • সুদ। এ নিয়ে আলোচনা আসছে।

  • পণ্য বিনিময়ে বেশি/কম করা। এ নিয়েও আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

  • ক্রয়-বিক্রয়ে বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বনের খেত্রেও রিবা শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন, সূরা নিসার ১৬১ নাম্বার আয়াত “আর এ কারণে যে, তারা রিবা গ্রহণ করত, অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, তারা অপরের সম্পদ ভোগ করতো অন্যায় ভাবে।” এর তাফসীরে কতিপয় মুফাসসিরগণ ‘রিবা’র তাফসীর করেছেন ক্রয়-বিক্রয়ে অবৈধ পন্থা হিসেবে।

  • প্রতিদান পাওয়ার আশায় কাউকে কিছু দেয়ার ক্ষেত্রেও রিবা শব্দটি ব্যবহার হতে পারে। যেমন সূরা রূমের ৩৯ নাম্বার আয়াত “মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা ‘রিবা’তে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না” এর তাফসীরে অনেক মুফাসসির রিবাকে এই অর্থেই নিয়েছেন।

  • যে কোন হারাম কাজের ক্ষেত্রেও রিবা ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন ‘কানযুল উম্মাল’ এ একটি হাদীস পাওয়া যায়, যেখানে বলা হচ্ছে, “সবচাইতে নিকৃষ্ট রিবা হল এক ভাই আরেক ভাই এর মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করা।”

তবে শেষ তিন প্রকারে রিবা শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে কিংবা একেবারেই অপ্রচলিত।


আরবী ভাষায় ربا (রিবা) এর শাব্দিক অর্থ হল আধিক্য, বৃদ্ধি, অতিক্রম করা, আকার ও সংখ্যায় কোন কিছু বৃদ্ধি পাওয়া। আহকামুল কুর’আন গ্রন্থে ইবনুল আরাবী বলেন, “রিবার আভিধানিক অর্থ হল বৃদ্ধি।”

তাই ব্যবসা ও ক্রয়-বিক্রয়ে অতিরিক্ত নেবার ক্ষেত্রে কিছু কিছু অতিরিক্ত নেওয়াকে ইসলামে রিবা বলা হয় এবং তা হারাম করা হয়েছে। তবে সব প্রকার অতিরিক্ত গ্রহণই রিবা নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু প্রকার অতিরিক্ত গ্রহণই হল রিবা।


ইসলামে ব্যবসা ও বিনিময় সংক্রান্ত মুয়ামালাতে রিবা মূলত দুই রকম।

১। রিবা আন–নাসি’আতু [ربا النسيئة]

২। রিবা আল-ফাদল [ربا الفضل]




রিবা আন–নাসি’আ [ربا النسيئة]


রিবা আন-নাসি’আকে অনেক ফকীহ রিবা আল-কুর’আন [ربا القران] হিসেবেও নামকরণ করেছেন কেননা এই ধরণের রিবার কথা সরাসরি কুর’আনে এসেছে।

এই প্রকারের সুদের সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য, সালাফ আস সালেহীনের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে সহজবোধ্য হয়ে যায়।


আলী (রা) বলেছেন,

“যে ঋণ লাভ টেনে আনে, তাই সুদ”। [আল ‘আযীযী (হাসান লি ঘাইরিহী), আসসিরাজুল মুনীর, মিসর]

ফুযালা ইবন উবাইদ (রা) বলেছেন, “যে ঋণ লাভ টেনে আনে, তা এক প্রকারের সুদ” [বাইহাকী]

ইমাম আবূ বাকর জাসসাস রাযী রিবা আন-নাসি’আকে রিবা আল-কুর’আন নামকরণ করে বলেন,

“মেয়াদের ভিত্তিতে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের শর্তে যে ঋণ দেয়া হয়, তাকে রিবা আল-কুর’আন বলে” [আহকামুল কুর’আন, মিসর]

ইবন জারীর বলেন,  “জাহিলী যুগে প্রচলিত ও কুর’আনে নিষিদ্ধ রিবা হল কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ দিয়ে মূলধনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করা।” [তাফসীর ইবন জারীর]


আরবী ভাষার সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত আবূ ইসহাক যাজ্জাজ রিবা আন নাসি’আকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে,

“প্রদত্ত ঋণের পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত উসূল করাই হল রিবা” [তাজুল ‘উরূস]



উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোকে সহজ করে বলতে গেলে যা দাঁড়ায় তা হল, ঋণ দিয়ে সেই ঋণ ফেরত নেবার সময় চুক্তি মোতাবেক কেউ যদি ১ পয়সাও অতিরিক্ত গ্রহণ করে, তবে সেই ১ পয়সা হবে রিবা আন-নাসি’আ। অর্থাৎ ঋণের মূলধনের সাথে কেউ যদি অতিরিক্ত কোন অর্থ আদায় করে, তবে সেটাই রিবা।

এখানে স্পষ্ট একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন, সেটি হল ইসলামে ঋণের ধারণা খুবই সহজ। ইসলামের ঋণের কোন অতিরিক্ত ফায়দা আসতে পারে না। অর্থাৎ কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয়, নির্দিষ্ট সময় পরেও সেই টাকা ফেরত নিতে গেলে তাকে ১০০ টাকাই ফেরত নিতে হবে। ১০১ টাকাও নিতে পারবেনা। এই কারণে ইসলামে ঋণের প্রকারভেদ একটাই। আর সেটা হল কারদ আল-হাসানা। ইসলামে এই কারদ আল-হাসানা ব্যতীত কোন প্রকার ঋণের স্থান নেই। অর্থাৎ ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত অর্থসহ তা ফেরত নেয়া ইসলামে কোন ক্রমেই জায়িয নয়, এবং কেউ যদি এইভাবে ঋণ ফেরত নিয়ে থাকে, তবে সেটা রিবা আন-নাসি’আ। যেমনটা আমরা সালাফদের সংজ্ঞা থেকে জানলাম। এখানে আরো বলে রাখা প্রয়োজন, আমরা আমাদের সমাজে সুদ বলতে যা বুঝি, তা মূলত রিবা আন-নাসি’আ। অর্থাৎ এক প্রকারের রিবা। রিবা মানেই শুধু সুদ নয়। বরং রিবা আন-নাসি’আ মানে সুদ।


উল্লেখ্য, ঋণের অতিরিক্ত আদায় রিবা হবে তখনই, যখন তা চুক্তিতে উল্লেখ করা থাকবে। কিন্তু চুক্তির বাইরে কেউ যদি স্বেচ্ছায়, উপহার হিসেবে কাউকে অতিরিক্ত দান করে, সেক্ষেত্রে তা হিবা বা গিফট হিসেবেই গণ্য হবে। রিবা নয়।


জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে আসি যখন তিনি মাসজিদে ছিলেন আর আমাকে বললেন, ‘দুই রাকাত পড়ে নাও’। আমি তার পাওনাদার ছিলাম, তাই তিনি আমার পাওয়া ফেরত দিলেন আর কিছু অতিরিক্তও দিলেন।” [বুখারী ৪৪৩]

এছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এক ব্যক্তির কাছে একটি বাচ্চা উট ধার নেন। ফেরত দেবার সময় সাহাবীরা ঐ বাচ্চা উটটি খুঁজে পেলেন না। পরিবর্তে পেলেন এমন একটি উট যা কিছুটা যৌবন প্রাপ্ত ও হৃষ্টপুষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বললেন, “(এটিকেই) দিয়ে দাও। তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে ধার শোধে উত্তম।” [বুখারী ২৩০৫]


হাদীসদ্বয় থেকে জানা যায়, এই অতিরিক্ত দান যদি চুক্তিতে উল্লেখ না থাকে, এবং তা দেনাদারের স্বেচ্ছায় ও খুশিতে হয়ে থাকে, তাহলে এই অতিরিক্ত প্রদান-গ্রহণ করা জায়িয। আর যদি চুক্তি করা থাকে, যে ফিরিয়ে দেবার সময় কিছু অতিরিক্ত দিতে হবে, তবে সেটা রিবা আন-নাসি’আ এবং তা হারাম।


আরো বিস্তারিতভাবে বলা যায়, যদি কোন ব্যক্তি কাউকে ঋণ দেবার সময় এই বলে ঋণ দেয়, যে ফেরত দেবার সময় অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে, তাহলে এই অতিরিক্ত হল রিবা আন নাসি’আ। আর যদি কোনরূপ কিছুই বলা না থাকে বা চুক্তি করা না থাকে, অর্থাৎ কারদ আল-হাসানা দেয়, কিন্তু ঋণ গ্রহীতা নিজ খুশিতেই ফেরত দেবার সময় উত্তম কিছু বা অতিরিক্ত কিছু দেয়, তাহলে এটি রিবা নয়।



[এই পর্বে রিবা আন-নাসি’আ নিয়ে আলোচনা করা হল। পরবর্তী পর্বে রিবার দ্বিতীয় প্রকার – রিবা আল-ফাদল নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্‌]


এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞানী

No comments:

Post a Comment

Plz spread this word to your friends