[প্রথম পর্বের লিংক: http://goo.gl/IhWcQi]
আমরা গত পর্বে জেনেছি ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল সম্পদের সুষম বন্টন। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অর্থনীতির তত্ত্ব যদিও সেই কথাই বলে, তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, সম্পদ কেবল বিত্তশালীদের হাতেই ঘুরপাক খায়। অথচ সম্পদ যাতে শুধুমাত্র বিত্তশালীদের হাতে পুঞ্জিভূত না হয়, সেটার দিকেই মূল লক্ষ্য রাখে ইসলামি অর্থনীতি। আল্লাহ্ তা’লা বলেন,
আর এই সম্পদের সুষম বন্টনের ক্ষেত্রে প্রধান যে বাধার মুখোমুখি হতে হয়, তা হল সুদ। সুদ এমনই একটি মারাত্মক জুলম, যা বিত্তশালীদের পকেট ভারী করে সাধারণ জনতাকে পথে বসিয়ে দেয়। সুদের বাস্তবিক অপকারিতা নিয়ে ইনশাআল্লাহ্ বিস্তারিত আসবে পরবর্তী পর্বগুলোতে।
ইসলামি অর্থনীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল, এটি সুদ অস্বীকার করে। সুদের অস্তিত্ব বিলীন করতে চায় এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করে। অথচ আমাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে সুদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই ইসলামে সুদের ব্যপারে কী বলা হয়েছে, কীভাবে সুদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, কোন পর্যায়ে একে হারাম করা হয়েছে, আমাদের বর্তমান সুদী ব্যবস্থা এর সাথে কতটা যুক্ত, সে সংক্রান্ত জ্ঞান আহরণ করা প্রত্যকে ঈমানদার মুসলিমের উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সুদের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম যদি দেখা হয়, তাহলে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট আদেশ লক্ষ্যণীয়।
কুরআন মাজিদ ও সুদ
সুদের ব্যপারে আল্লাহ্ সুবহানাহুওয়া তা’লা কুরআনে একাধিক আয়াত নাযিল করেছেন। এইসব আয়াতে দেখার বিষয় হল, আল্লাহ্ আযাযা ওয়া জাল সুদকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি এবং কঠোর ভাষায় হারাম ঘোষনা করে দিয়েছেন। কোন অবস্থাতেই আমরা সুদকে হালাল করার সুযোগ পাচ্ছি না।
সুদের সাথে এইভাবেই সরাসরি সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন আল্লাহ্। বর্তমান সুদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতার ওপর যদি ঋণ পরিশোধ কোন কারণে কষ্টকর হয়ে যায়, তাহলে ফাইনান্স হাউসগুলো তাকে ছাড় দেয় না। মর্টগেজ বা বন্ধক বিক্রি করে তারা সুদ ও আসল তুলে নিয়ে আসে। অথচ আল্লাহ্ বলছেন,
লক্ষ্য করুন, ঋণ পরিশোধের সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ঋণ দাতার অবশ্যই দাবি থাকে সেই ঋণের ওপর এবং বর্তমান ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতার লেপ কম্বল বিক্রি করে হলেও সুদ আদায় করা হয়। কিন্তু আল্লাহ্ বলছেন তাকে সময় দিতে! কোন অবস্থাতেই যাতে তাকে অতিরিক্ত উসুল বা সুদের খপ্পরে পড়তে না হয়। যদিও ইসলামি ঋণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সুদমুক্ত।
তাই কুরআন মাজিদের আলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সুদের ব্যপারে এক বিন্দু ছাড় দেয়া সম্ভব নয়।
হাদীস ও সুদ
কুরআন এর আয়াতের আলোকে রাসূলুল্লাহ [ﷺ] একাধিকবার সুদের ব্যাপারে এই উম্মাহকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। দিয়েছেন অভিশাপ ও ভয়ঙ্কর শাস্তির খবর।
রাসূল [ﷺ] এর হাদীস থেকেও দেখা যাচ্ছে সুদের হারাম হবার কথা। উল্লিখিত সহীহ হাদীসগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য হাসান পর্যায়ের ও কিছু দুর্বল বর্ণনার হাদীসও রয়েছে, যাতে বর্ণিত হয়েছে সুদের ভয়ানক পরিণতির কথা। কোনটায় আল্লাহ্র রাসূল [ﷺ] বলেছেন তিনি মিরাজের সময় সুদখোরদের পেটে সাপ কিলবিল করতে দেখেছেন, কোনটায় তিনি বলেছেন একজন মুসলিমের এক দিরহাম সুদ গ্রহণ করা ৩৩ বা ৩৬ বার ব্যভিচার/জিনা করার চাইতেও জঘন্য।
ইসলাম ও সুদ
কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কোন মুসলিমের পক্ষে সুদকে হালাল ভাবার কোন সম্ভাবনা ও সুযোগ নেই। ইসলামে অত্যন্ত জঘন্য একটি স্থান দখল করে আছে সুদ। ভেবে দেখুন, কেউ তার জন্মদাত্রী মায়ের সাথে ব্যভিচার করতে পারে কি? সম্ভব? অথচ সুদ খাওয়ার ৭৩ টি গুনাহ এর সর্বনিম্ন গুনাহ হল সেই ব্যক্তির গুনাহ এর সমান, যে তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের সাথে জিনা করে।
ভেবে দেখুন তো, কেউ একই দিনে ৩৬ বার জিনা করে ফেলেছে! কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার গুনাহ? তার শাস্তি? অথচ এক দিরহাম সুদ গ্রহণকে ৩৬ বার জিনা করার চাইতেও জঘন্যতর আখ্যা দেয়া হয়েছে।
তাহলে আমাদের কি এতটুকু সতর্ক হবার প্রয়োজন নেই? আমাদের কি এতটুকু ভীত হবার দরকার নেই? আমাদের এতটুকু চিন্তা করার অবকাশ নেই যে আমরা সুদকে কীভাবে নিচ্ছি?
আসুন আমরা নিজেদের চারটি প্রশ্ন করি।
- আমরা কি সুদ নিচ্ছি?
- আমরা কি সুদ দিচ্ছি?
- আমরা কি সুদী কারবার লিখে রাখছি?
- আমরা কি সুদী কারবারে সাক্ষী থাকছি/ভূমিকা রাখছি?
এই চার শ্রেণীর মানুষকেই আল্লাহ্র রাসূল [ﷺ] অভিশাপ দিয়ে বলেছেন এরা সবাই একই গুনাহগার!
আমরা অনেকেই হয়তো নামায পড়ি, রোজা রাখি, কুরআন পাঠ করি, চেষ্টা করি হারাম কিছু না করতে, অথচ ঠিকই এমন ভাবে সুদী কারবারে জড়িয়ে পড়ছি, যেন এটা কোন বিষয়ই নয়!
অথচ যে ব্যক্তি হারাম উপার্জন করে তা দিয়ে উদরপূর্তি করে, তার দু’আ কিংবা ইবাদাত কবুলই হয় না! রাসূলাল্লাহ [ﷺ] বলেন,
স্কলারদের মতে যে শরীর হারাম উপার্জনে পুষ্টি লাভ করে, সে শরীর আল্লাহ্র নিকট অপবিত্র। ফলে তাঁর ইবাদত কী উপায়ে কবুল করে পারে?
স্পষ্টতই সুদের ব্যাপারে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল [ﷺ] অত্যন্ত কঠোর নীতি অবলম্বন করেছেন। যে ব্যক্তি সুদের সাথে সম্পর্ক রাখে, আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন সে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহর [ﷺ] সাথে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মুসলিম কখনই আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের [ﷺ] সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা সুদূর কল্পনাতেও আনবেন না। কিন্তু সুদী কারবারে লিপ্ত হয়ে অনেকেই প্রতিনিয়ত আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের [ﷺ] বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন।
একজন মুসলিমের কাছে আল্লাহ্র আদেশ ও নিষেধের বাইরে কোন কিছুই বলার থাকে না, কোন কিছুই করার থাকে না। একজন মুসলিম সেটাই মেনে নেবে যা আল্লাহ্ আদেশ করেছেন। আর সেখান থেকেই দূরে থাকবে যা আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন,
অর্থাৎ আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল [ﷺ] যখন কোন বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন, তখন মু’মিন পুরুষ ও নারী কারোরই কোন এখতিয়ার নেই সেখানে দ্বিমত পোষণ করার।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’লা সুদকে হারাম করেছেন তো আমরাও মেনে নেব। কোন প্রশ্ন ছাড়া। কোন তর্ক ছাড়া। আল্লাহ্ মুসলিমদের পরিচয় কুরআনে এভাবেই দিয়েছেন,
[এ পর্বে আমাদের আলোচনা ছিল সুদের হারাম হবার হুকুমের ওপর। পরবর্তী পর্বে সুদ ও রিবা এর সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।]
এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞানী
আমরা গত পর্বে জেনেছি ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল সম্পদের সুষম বন্টন। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অর্থনীতির তত্ত্ব যদিও সেই কথাই বলে, তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, সম্পদ কেবল বিত্তশালীদের হাতেই ঘুরপাক খায়। অথচ সম্পদ যাতে শুধুমাত্র বিত্তশালীদের হাতে পুঞ্জিভূত না হয়, সেটার দিকেই মূল লক্ষ্য রাখে ইসলামি অর্থনীতি। আল্লাহ্ তা’লা বলেন,
"আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।" [সূরাহ হাশর: আয়াত ৭]
আর এই সম্পদের সুষম বন্টনের ক্ষেত্রে প্রধান যে বাধার মুখোমুখি হতে হয়, তা হল সুদ। সুদ এমনই একটি মারাত্মক জুলম, যা বিত্তশালীদের পকেট ভারী করে সাধারণ জনতাকে পথে বসিয়ে দেয়। সুদের বাস্তবিক অপকারিতা নিয়ে ইনশাআল্লাহ্ বিস্তারিত আসবে পরবর্তী পর্বগুলোতে।
ইসলামি অর্থনীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল, এটি সুদ অস্বীকার করে। সুদের অস্তিত্ব বিলীন করতে চায় এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করে। অথচ আমাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে সুদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই ইসলামে সুদের ব্যপারে কী বলা হয়েছে, কীভাবে সুদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, কোন পর্যায়ে একে হারাম করা হয়েছে, আমাদের বর্তমান সুদী ব্যবস্থা এর সাথে কতটা যুক্ত, সে সংক্রান্ত জ্ঞান আহরণ করা প্রত্যকে ঈমানদার মুসলিমের উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সুদের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম যদি দেখা হয়, তাহলে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট আদেশ লক্ষ্যণীয়।
কুরআন মাজিদ ও সুদ
সুদের ব্যপারে আল্লাহ্ সুবহানাহুওয়া তা’লা কুরআনে একাধিক আয়াত নাযিল করেছেন। এইসব আয়াতে দেখার বিষয় হল, আল্লাহ্ আযাযা ওয়া জাল সুদকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি এবং কঠোর ভাষায় হারাম ঘোষনা করে দিয়েছেন। কোন অবস্থাতেই আমরা সুদকে হালাল করার সুযোগ পাচ্ছি না।
“মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে।“ [সূরাহ আর রূম: আয়াত ৩৯]
“বস্তুতঃ ইহুদীদের জন্য আমি হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র বস্তু যা তাদের জন্য হালাল ছিল-তাদের পাপের কারণে এবং আল্লাহর পথে অধিক পরিমাণে বাধা দানের দরুন। আর এ কারণে যে, তারা সুদ গ্রহণ করত, অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, তারা অপরের সম্পদ ভোগ করতো অন্যায় ভাবে। বস্তুত; আমি কাফেরদের জন্য তৈরী করে রেখেছি বেদনাদায়ক আযাব।” [সূরাহ আন নিসা: আয়াত ১৬০ -১৬১]
“ঈমানদারগণ! তোমরা সুদের উপর সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পারো।” [সূরাহ আলি ইমরাআন: আয়াত ১৩০]
“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছেঃ ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লা’হ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৫]
“আল্লাহ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৬]
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৮]
“অতঃপর যদি তোমরা (সুদ) পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৯]
সুদের সাথে এইভাবেই সরাসরি সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন আল্লাহ্। বর্তমান সুদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতার ওপর যদি ঋণ পরিশোধ কোন কারণে কষ্টকর হয়ে যায়, তাহলে ফাইনান্স হাউসগুলো তাকে ছাড় দেয় না। মর্টগেজ বা বন্ধক বিক্রি করে তারা সুদ ও আসল তুলে নিয়ে আসে। অথচ আল্লাহ্ বলছেন,
“যদি কেউ যদি অভাবগ্রস্থ হয়, তবে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম যদি তোমরা উপলব্ধি কর।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৮০]
লক্ষ্য করুন, ঋণ পরিশোধের সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ঋণ দাতার অবশ্যই দাবি থাকে সেই ঋণের ওপর এবং বর্তমান ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতার লেপ কম্বল বিক্রি করে হলেও সুদ আদায় করা হয়। কিন্তু আল্লাহ্ বলছেন তাকে সময় দিতে! কোন অবস্থাতেই যাতে তাকে অতিরিক্ত উসুল বা সুদের খপ্পরে পড়তে না হয়। যদিও ইসলামি ঋণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সুদমুক্ত।
তাই কুরআন মাজিদের আলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সুদের ব্যপারে এক বিন্দু ছাড় দেয়া সম্ভব নয়।
হাদীস ও সুদ
কুরআন এর আয়াতের আলোকে রাসূলুল্লাহ [ﷺ] একাধিকবার সুদের ব্যাপারে এই উম্মাহকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। দিয়েছেন অভিশাপ ও ভয়ঙ্কর শাস্তির খবর।
রাসূল সেই নারীকে অভিশাপ দিয়েছেন যে ট্যাটু আঁকা চর্চা করে এবং সেই নারী যে ট্যাটু আঁকায়, এবং সেই ব্যক্তি যে সুদ ভক্ষণ করে এবং যে সুদ দেয়। [সহীহ আল বুখারী : ৫৩৪৭]
আল্লাহ্র রাসূল অভিশাপ দিয়েছেন সুদ গ্রহীতা, সুদ দাতা, সুদের হিসাবরক্ষের এবং এ ব্যাপারে সাক্ষ্যদানকারীর ওপর আর বলেছেন “ওরা সকলেই সমান” [সহীহ মুসলিম ১৫৯৭]
সুদের ৭৩ টি অপকারিত রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বনিম্ন হল আপন মায়ের সাথে জিনা/ব্যভিচার করা। [সুনান ইবন মাজাহ : ২২৭৪ {হাসান হাদীস (দারুস সালাম)। সোর্স: Sunnah.com}]
রাসূল বলেন, “তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্তু থেকে বেচে থাকো।” সাহাবীগণ বললেন, “হে আল্লাহ্র রাসূল! সেগুলো কী?” তিনি উত্তরে বললেন, “আল্লাহ্র সাথে শিরক করা,জাদু করা,অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ গ্রাস করা, যুদ্ধের সময় পলায়ন করা, সতী-সাধ্বী নিরীহ ঈমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা।” [সহীহ আল বুখারী : ৬৮৫৭]
আল্লাহ্র রাসূল যে ব্যক্তি সুদ নেয় ও যে ব্যক্তি সুদ দেয়, তাদের অভিশাপ দিয়েছেন [সহীহ মুসলিম : ১৮:১০৫]
আল্লাহ্র রাসূল বলেন, এমন একটি সময় আসবে, যখন সুদ খাবেনা এমন কেউ থাকবেনা, আর কেউ যদি সুদ নাও খায়, তবু এর ধূলোবালি থেকে রক্ষা পাবে না। [ইবন মাজাহ, আবু দাউদ, আল জামি’আল আসগার {সুয়ুতী, পৃষ্ঠা ৭৫৩১ : সহীহ (সোর্স: hdith.com)}]
রাসূল [ﷺ] এর হাদীস থেকেও দেখা যাচ্ছে সুদের হারাম হবার কথা। উল্লিখিত সহীহ হাদীসগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য হাসান পর্যায়ের ও কিছু দুর্বল বর্ণনার হাদীসও রয়েছে, যাতে বর্ণিত হয়েছে সুদের ভয়ানক পরিণতির কথা। কোনটায় আল্লাহ্র রাসূল [ﷺ] বলেছেন তিনি মিরাজের সময় সুদখোরদের পেটে সাপ কিলবিল করতে দেখেছেন, কোনটায় তিনি বলেছেন একজন মুসলিমের এক দিরহাম সুদ গ্রহণ করা ৩৩ বা ৩৬ বার ব্যভিচার/জিনা করার চাইতেও জঘন্য।
ইসলাম ও সুদ
কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কোন মুসলিমের পক্ষে সুদকে হালাল ভাবার কোন সম্ভাবনা ও সুযোগ নেই। ইসলামে অত্যন্ত জঘন্য একটি স্থান দখল করে আছে সুদ। ভেবে দেখুন, কেউ তার জন্মদাত্রী মায়ের সাথে ব্যভিচার করতে পারে কি? সম্ভব? অথচ সুদ খাওয়ার ৭৩ টি গুনাহ এর সর্বনিম্ন গুনাহ হল সেই ব্যক্তির গুনাহ এর সমান, যে তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের সাথে জিনা করে।
ভেবে দেখুন তো, কেউ একই দিনে ৩৬ বার জিনা করে ফেলেছে! কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার গুনাহ? তার শাস্তি? অথচ এক দিরহাম সুদ গ্রহণকে ৩৬ বার জিনা করার চাইতেও জঘন্যতর আখ্যা দেয়া হয়েছে।
তাহলে আমাদের কি এতটুকু সতর্ক হবার প্রয়োজন নেই? আমাদের কি এতটুকু ভীত হবার দরকার নেই? আমাদের এতটুকু চিন্তা করার অবকাশ নেই যে আমরা সুদকে কীভাবে নিচ্ছি?
আসুন আমরা নিজেদের চারটি প্রশ্ন করি।
- আমরা কি সুদ নিচ্ছি?
- আমরা কি সুদ দিচ্ছি?
- আমরা কি সুদী কারবার লিখে রাখছি?
- আমরা কি সুদী কারবারে সাক্ষী থাকছি/ভূমিকা রাখছি?
এই চার শ্রেণীর মানুষকেই আল্লাহ্র রাসূল [ﷺ] অভিশাপ দিয়ে বলেছেন এরা সবাই একই গুনাহগার!
আমরা অনেকেই হয়তো নামায পড়ি, রোজা রাখি, কুরআন পাঠ করি, চেষ্টা করি হারাম কিছু না করতে, অথচ ঠিকই এমন ভাবে সুদী কারবারে জড়িয়ে পড়ছি, যেন এটা কোন বিষয়ই নয়!
অথচ যে ব্যক্তি হারাম উপার্জন করে তা দিয়ে উদরপূর্তি করে, তার দু’আ কিংবা ইবাদাত কবুলই হয় না! রাসূলাল্লাহ [ﷺ] বলেন,
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।’’ আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।’’ অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছেঃ হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?’’ [সহীহ মুসলিম : ১০১৫]
আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম। [জামি’ আত তিরমিদি : ৬১৪ {হাসান হাদীস: দারুস সালাম (সোর্স: Sunnah.com)} ]
স্কলারদের মতে যে শরীর হারাম উপার্জনে পুষ্টি লাভ করে, সে শরীর আল্লাহ্র নিকট অপবিত্র। ফলে তাঁর ইবাদত কী উপায়ে কবুল করে পারে?
স্পষ্টতই সুদের ব্যাপারে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল [ﷺ] অত্যন্ত কঠোর নীতি অবলম্বন করেছেন। যে ব্যক্তি সুদের সাথে সম্পর্ক রাখে, আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন সে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহর [ﷺ] সাথে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মুসলিম কখনই আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের [ﷺ] সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা সুদূর কল্পনাতেও আনবেন না। কিন্তু সুদী কারবারে লিপ্ত হয়ে অনেকেই প্রতিনিয়ত আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের [ﷺ] বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন।
একজন মুসলিমের কাছে আল্লাহ্র আদেশ ও নিষেধের বাইরে কোন কিছুই বলার থাকে না, কোন কিছুই করার থাকে না। একজন মুসলিম সেটাই মেনে নেবে যা আল্লাহ্ আদেশ করেছেন। আর সেখান থেকেই দূরে থাকবে যা আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন,
"আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট তায় পতিত হয়।" [সূরাহ আল আহযাব : আয়াত ৩৬]
অর্থাৎ আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল [ﷺ] যখন কোন বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন, তখন মু’মিন পুরুষ ও নারী কারোরই কোন এখতিয়ার নেই সেখানে দ্বিমত পোষণ করার।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’লা সুদকে হারাম করেছেন তো আমরাও মেনে নেব। কোন প্রশ্ন ছাড়া। কোন তর্ক ছাড়া। আল্লাহ্ মুসলিমদের পরিচয় কুরআনে এভাবেই দিয়েছেন,
তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। [সূরাহ নূর : আয়াত ৫১]
[এ পর্বে আমাদের আলোচনা ছিল সুদের হারাম হবার হুকুমের ওপর। পরবর্তী পর্বে সুদ ও রিবা এর সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।]
এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞানী
No comments:
Post a Comment
Plz spread this word to your friends