আল্লাহ্‌র মনোনীত জীবন ব্যবস্থায় সুদ : পর্ব ৫ - রিবার পরিচয় ৩

[পর্ব ৪: http://goo.gl/O7kDU1 


গত পর্বে আমরা রিবা আল ফাদল নিয়ে প্রথম ধাপের আলোচনা করেছি। এই পর্বে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা করা হল।  


আমরা এখন জানলাম রিবাউই পণ্য হাদীসে উল্লিখিত ৬ টি পণ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেসকল পণ্যের মাঝে রিবাউই পণ্যের মূল বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে, সেসকল পণ্যই রিবাউই পণ্য হিসেবে গণ্য হবে। এখন আমরা রিবাউই পণ্যের পারস্পরিক বিনিময়ের কিছু হুকুম আরেকটু বিশ্লেষিত আকারে দেখব, যা পূর্বে অল্প আলোচনা করা হয়েছে।


রিবাউই পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের মূলনীতিগুলো ইমাম নববী বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে এনেছেন। তা নিম্নরূপ:

  • যদি দুটো পণ্যের মূল বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়, তাহলে পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বেশ/কম ও বাকি রাখা উভয়ই জায়েয। যেমন, টাকার বিনিময়ে চাল ক্রয় করা। এক্ষেত্রে চালের পরিমাণ আর টাকার পরিমাণ এক হতে হবে কথা নেই এবং আপনি চাইলে বাকিতেও চাল কিনতে পারেন।

  • যদি দুটো পণ্য একইরকম হয়, তাহলে পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বেশ/কম ও বাকি রাখা উভয়ই নাজায়েয। যেমন, বাংলাদেশি টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি টাকা ক্রয় করা। পুরানো টাকা দিয়ে নতুন টাকা কেনা আমরা প্রায়ই দেখি। সাধারণত নতুন ১০০ টাকার নোট কিনতে পুরোনো ১১০ টাকা দিতে হয়। কিন্তু এটা রিবা। হালাল লেনদেন হতে হলে এক্ষেত্রে পুরোনো আর নতুন উভয় টাকার মূল্য সমান হতে হবে। অর্থাৎ ১০০ টাকার নতুন নোট কিনতে হলে বিনিময়ে পুরোনো নোট ১০০ টাকাই দিতে হবে। বেশি বা কম দেয়া যাবে না। এছাড়া এই লেনদেন বাকিতে করা যাবে না। আপনি বলতে পারেন না, “আমাকে নতুন ১০০ টাকার নোট দাও, আমি তোমাকে এখন ৫০ টাকার পুরনো নোটটা দিলাম, বাকি ৫০ টাকা আগামীকাল দেব।”

  • যদি দুটো পণ্য ভিন্ন রকম হয় কিন্তু মূল বৈশিষ্ট্য একই হয়, তাহলে বেশ/কম জায়েয, কিন্তু বাকি রাখা নাজায়েয। যেমন, বাংলাদেশি টাকা দিয়ে ইউএস ডলার কেনা। আপনি বাংলাদেশি ৮০ টাকা দিয়ে ইউএসএ এর ১ ডলার কিনতে পারেন, অর্থাৎ বেশ/কম করতে পারেন, তবে তা একই মাজলিস বা সেশানে হতে হবে। বাকি রাখা যাবে না। আপনি আজকে বাংলাদেশি ৮০ টাকা দিলেন, ইউএস ১ ডলার আগামীকাল নেবেন, এটা হতে পারবে না। 


ইমাম নববীর মূলনীতির দ্বিতীয় যে নীতি, অর্থাৎ সমজাতীয় পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের বিষয়টি আরেকটু বিশ্লেষণ করা যায়। এই ধরণের বিনিময়ে মূলত চারটি বিষয় বিবেচনাধীন থাকে। আর সেসব হল:

  • সমজাতীয় পণ্য পরস্পর বিনিময় করার ক্ষেত্রে উন্নত-অনুন্নত ভেদাভেদ করা যাবে না। অর্থাৎ, নতুন স্বর্ণের সাথে পুরাতন স্বর্ণের বিনিময়ের ক্ষেত্রে কম-বেশ করা যাবেনা। সমান সমান হতে হবে। তেমনি উন্নত মানের চালের বিনিময়ে নিম্ন মানের চাল নেয়ার ক্ষেত্রেও কম-বেশ করা যাবে না। সমান সমান হতেই হবে। এক্ষেত্রে ‘বাজার মূল্য’ মাথায় রাখা চলবে না। একটু আগে যে নতুন টাকা ও পুরোনো টাকার উদাহরণ দিয়েছি, সেটাও এই হুকুমের অধীন।
তবে শরীয়ত এই ক্ষেত্রে একটি সমাধান দেয়। সেটি হল, যদি পণ্যগুলো বিক্রয়যোগ্য হয়, তবে একটি পণ্য বিক্রি করে দিয়ে তা টাকায় রূপান্তর করে, তারপর অন্য পণ্যটি কেনা যায়। ফলে আর রিবায় লিপ্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। যেমন, যদি ভালো মানের এক কেজি গম, আর একটু নিম্ন মানের দুই কেজি গমের মাঝে  বিনিময় করা হয়, সেটা হবে রিবা। এক্ষেত্রে সমাধান হল, নিম্ন মানের ২ কেজি গমকে বাজারে বিক্রি করে দিয়ে যে টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা দিয়ে ভালো মানের  এক কেজি গম কেনা।  
  • সমজাতীয় পণ্য যদি একইরূপ হয়, তাহলে লেনদেনে কোনরূপ বেশ/কম করা যাবে না। ধরা যাক, আপনার কাছে কিছু স্বর্ণ আছে আর আপনি সেই স্বর্ণের বিনিময়ে একটি শো-পীস এর দোকান থেকে সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি একটি শো-পীস কিনতে চান। এই ক্ষেত্রে আপনাকে সেই স্বর্ণের শো-পীস কিনতে সমপরিমাণ স্বর্ণ দিয়েই কিনতে হবে। যদি শো-পীসটি ১ ভরি ওজনের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে তা আপনাকে ১ ভরি স্বর্ণের বিনিময়েই কিনতে হবে। অথবা আপনার স্বর্ণকে আগে বিক্রি করে টাকায় রূপান্তর করে তারপর শো-পীসটি কিনতে হবে।  
  • সমজাতীয় পণ্য যদি বৈশিষ্ট্যগত ভাবে কোনরকমের ভিন্ন বস্তুতে পরিণত হয়, অর্থাৎ দুটি সমজাতীয় পণ্যের মাঝে স্পষ্ট ভিন্নতা দেখা যায়, তাহলে বেশ/কম করা জায়েয। অর্থাৎ, যদি একটি পণ্য কাঁচামাল হয়, আর অপর পণ্যটি সেই কাঁচামাল দ্বারা প্রস্তুত কোন বস্তু হয়, এক্ষেত্রে বেশ/কম করা যাবে। যেমন, ইঞ্জিন তৈরি হয় লোহা লক্কড় দিয়ে। এখন লোহার বিনিময়ে কেউ যদি কোন একটি ইঞ্জিন নিতে চায়, তাহলে সেক্ষেত্রে বেশ/কম করা যাবে, যেহেতু শিল্পায়নের ফলে লোহার মৌলিক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেছে। ঠিক একই ভাবে তুলার সাথে সুতা কিংবা সুতার সাথে কাপড়ের লেনদেনের ক্ষেত্রেও এই হুকুম প্রযোজ্য। 
  • সমজাতীয় পণ্য যদি সোনা, রূপা বা মূদ্রা জাতীয় বস্তু হয়, অর্থাৎ বিনিময় মাধ্যম হয়, তাহলে পারস্পরিক লেনদেনের সময় নগদ তো হতে হবেই, সাথে উভয় পক্ষ নিজ নিজ পণ্যের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একে বলা হয় কাব্দ (বাংলায় কবজা বলা চলে)। অর্থাৎ স্পষ্টভাবেই তা দখলে চলে আসতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যায়েদ তার ৫০ ভরি রূপা যদি উমারের ৭ ভরি স্বর্ণের সাথে বিনিময় করতে চায়, তাহলে উভয়কেই নগদ বিনিময় করে স্পষ্টভাবেই সোনা ও রূপার দখল নিতে হবে। অর্থাৎ, যায়েদ ৭ ভরি স্বর্ণ তার কব্জায় নিয়ে নেবে আর উমার ৫০ ভরি রূপা তার কব্জায় নিয়ে নেবে। মূল বিষয় হল যায়েদ বা উমার উভয়েই নগদ বিনিময় করলেও, তা যদি নিজেদের কব্জায় নিয়ে না আসে, তাহলে লেনদেন শুদ্ধ হবে না। কিন্তু অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে এই কড়াকড়ি প্রযোজ্য নয়। যেমন, ফয়সাল যদি এক কেজি লবন যুবাইর এর আধা কেজি চিনির সাথে বিনিময় করে, তাহলে উভয়েই যদি নিজেদের পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণের দিকে নির্দেশ করে বলে, “আমরা বিনিময় করলাম” আর যদি ফয়সাল চিনির আর যুবাইর লবণের স্পষ্ট দখল না নিয়ে বলে “কিছুক্ষণ পর নিচ্ছি”, তাহলে এই বিনিময় শুদ্ধ। কিন্তু মূদ্রা জাতীয় পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে স্পষ্টভাবেই দখলে নিয়ে নেয়া জরুরী।     

 [এই পর্বের মাধ্যমে রিবা নিয়ে মৌলিক আলোচনা শেষ হল। আগামী পর্বগুলোতে বর্তমান ইকোনমিতে রিবার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।] 


     
ওয়াল্লাহু তা'আলা আ'লাম

আল্লাহ্‌র মনোনীত জীবন ব্যবস্থায় সুদ : পর্ব ৪ - রিবার পরিচয় ২

[পর্ব ৩: http://goo.gl/97Wbe2 


গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছি রিবার প্রথম প্রকার - রিবা আন নাসিআ নিয়ে। এ পর্বে আমরা আলোচনা করবো রিবার দ্বিতীয় প্রকার - রিবা আল ফাদল নিয়ে।


রিবা আল-ফাদল [ ربا الفضل

রিবার সবচাইতে ব্যপক প্রকার হল রিবা আল-ফাদল। রিবা আন-নাসি’আতু যেমন সহজবোধ্য আর পরিষ্কার, রিবা আল-ফাদল সে তুলনায় কিছুটা জটিল। এই প্রকারের রিবা যেহেতু হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত, তাই একে অনেক ফকীহ রিবা আল হাদীসও বলেছেন। 

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বিশেষ কোন পণ্য, সমজাত পণ্যের সাথে বিনিময় করার সময় যা অতিরিক্ত নেয়া হয়।

রিবা আল ফাদল মূলত যেই হাদীসের উপর ভিত্তি করে হারাম করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ।


“সোনার বিনিময়ে সোনা সমান সমান বিক্রয় কর।
রূপার বিনিময়ে রূপা সমান সমান বিক্রয় কর।
খেজুরের বিনিময়ে খেজুর সমান সমান বিক্রয় কর।
গমের বিনিময়ে গম সমান সমান বিক্রয় কর।
লবণের বিনিময়ে লবণ সমান সমান বিক্রয় কর।
যবের বিনিময়ে যব সমান সমান বিক্রয় কর।
যে বেশি আদানপ্রদান করলো সে রিবা আদান প্রদান করলো। আর রূপার বিনিময়ে স্বর্ণ যেভাবে ইচ্ছা, সে ভাবেই বিক্রয় করতে পারো। তবে শর্ত হল হাতে হাতে হতে হবে এবং খেজুরের বিনিময়ে যব যেভাবে ইচ্ছা বিক্রয় করতে পারো, শর্ত হল হাতে হাতে হতে হবে।” [তিরমীদির বর্ণনা]


এই হাদীসে ছয়টি বিশেষ পণ্যের কথা এসেছে, যেসব পণ্যের বিনিময়ের সময় একই জাতের হয়ে থাকলে একদম সমান সমান হতে হবে। অর্থাৎ ১০ গ্রাম সোনার বিনিময়ে ১১ গ্রাম সোনা দেয়া যাবে না। ১০ গ্রামই দিতে হবে। তেমনি ১০ গ্রাম রূপার বিনিময়ে ১১ গ্রাম রূপা দেয়া যাবে না। ১০ গ্রামই দিতে হবে। তেমনি খেজুর, গম, লবণ ও যবের স্বজাতি বিনিময়ের একই হুকুম। যেমন ১ কেজি খেজুরের বিনিময় ১ কেজি খেজুরের সাথেই হতে হবে। ১ কেজি ১ গ্রাম এর সাথেও হতে পারবে না।

অন্যদিকে, যদি সোনার সাথে রূপার কিংবা খেজুরের সাথে লবণের বিনিময় হয়ে থাকে, অর্থাৎ একই জাতের মধ্যে বিনিময় না হয়ে ভিন্ন জাতের মধ্যে বিনিময় হয়ে থাকে, তবে কম বেশি করা যাবে, তবে অবশ্যই তা নগদে হতে হবে। অর্থাৎ হাতে হাতে হতে হবে। বাকিতে করা যাবে না।

ইসলামি বেচা-কেনা পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মাজলিস। এর চলতি ভাষায় সহজ অর্থ করা যায় সেশান। অর্থাৎ একটি বেচাকেনা যেই সেশানের মধ্যে সম্পন্ন হয়, তাকে বলা হয় মাজলিস। মাজলিসের ওপর বেচাবিক্রির অনেক হুকুমই নির্ভর করে। এখানে রিবা আল ফাদল এর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মাজলিসের হুকুম হল, যদি উক্ত ৬ জাতের পণ্য পরস্পর বিনিময় করা হয়, অর্থাৎ, একই প্রকারের পণ্য পরস্পর বিনিময় করা হোক (যেমন, সোনার বিনিময়ে সোনা, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর) আর ভিন্ন প্রকারের পণ্য বিনিময় করা হোক (যেমন, সোনার বিনিময়ে গম, রূপার বিনিময়ে খেজুর, সোনার বিনিময়ে রূপা) তাহলে তা একই মাজলিসে সম্পন্ন হতে হবে। অর্থাৎ বাকি রাখা যাবে না।


আমওয়ালুর রিবায়াত

ফিকহের পরিভাষায় হাদীসে উল্লিখিত ৬ ধরণের পণ্যকে, সোনা, রূপা, খেজুর, গম, লবণ, যব - আমওয়ালুর রিবায়াত বা সুদী পণ্য বা রিবাউই পণ্য বলা হয়। কেননা এইসব পণ্যের পরস্পর বিনিময়ের ফলেই সুদ তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে।

তবে হাদীসে এটার উল্লেখ নেই, যে শুধুমাত্র এই ৬ পণ্যই কি তাহলে রিবাউই পণ্য বলে বিবেচ্য হবে?

এটি অনেক জটিল একটি প্রশ্ন, যার উত্তরে উলামা কিরাম মতপার্থক্য করেছেন। প্রাথমিক যুগের অনেক ফকীহ এর মত ছিল রিবাউই পণ্য শুধুমাত্র এই ৬টি পণ্যেই সীমাবদ্ধ। এর মাঝে আছেন কাতাদা (রহ) ও তাউস (রহ)। তবে অন্যান্য ফকীহগণ এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। পরবর্তী ফকীহদের কথা হল, আমাদের দেখা উচিৎ, এই ৬টি পণ্যের মাঝে আসলে মূল মিল কোন জায়গায়, অর্থাৎ এদের মূল বৈশিষ্ট্য কী। যদি কোন পণ্যের মাঝে ঐ মৌলিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তাহলে সেটিও রিবাউই পণ্য হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সালাফ উস সালেহীনগণ কয়েকটি মত দিয়েছেন।

  • ইমাম আবু হানিফা (রহ) বলেন, এই ৬ পণ্যের মূল বৈশিষ্ট্য হল পরিমাপ ও ওজন। অর্থাৎ এই ৬ টি পণ্যকে পাত্র দারা পরিমাপ করা যায় ও ওজন করে বিক্রি করা যায়। তাই অন্য যে কোন পণ্য যদি পাত্র দ্বারা পরিমাপ করা যায় আর ওজন করে বিক্রি করা যায়, তাহলে সেটাও রিবাউই পণ্য হবে। 
  • ইমাম মালিক (রহ) বলে, এই ৬ পণ্যের মূল বৈশিষ্ট্য হল খাদ্য জাতীয় হওয়া এবং গুদামজাত করা উপযুক্ত হওয়া। তাই যে কোন পণ্য যা খাওয়া যায় কিংবা গুদামজাত করা যায়, সেটাই রিবাউই পণ্য। 
  • ইমাম শাফিঈ (রহ) বলেন, এই ৬ পণ্যের মূল বৈশিষ্ট্য হল খাদ্যবস্তু হওয়া ও মূদ্রা জাতীয় হওয়া। সোনা-রূপাকে মূদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা যায় ও বাকি ৪ টি খাদ্য হিসেবে খাওয়া যায়। তাই যে কোন বস্তু যা মূদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিংবা খাবার হিসেবে খাওয়া যায়, সেটিই রিবাউই পণ্য হবে।  
  • ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (রহ) এর কাছ থেকে তিনটি মত পাওয়া যায়। যার একটি ইমাম আবু হানিফার (রহ) অনুরূপ, একটি ইমাম শাফিঈ (রহ) এর অনুরূপ এবং তৃতীয়টি তার নিজস্ব মত যা হল, সোনা-রূপা ছাড়া অন্য যে কোন পণ্যের মধ্যে যদি খাদ্য জাতীয় হওয়া, পরিমাপ করে ও ওজন করে বিক্রি করা – এই তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তাহলে তা রিবাউই পণ্য হিসেবে গণ্য হবে।

কাজেই আমরা দুইরকম পণ্য পেলাম।
প্রথমটি হল, যেসব পণ্য বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দ্বিতীয়টি হল, খাদ্যজাতীয় পণ্য যা ওজন আর পরিমাপ করে বিক্রি করা যায়।

তাই যেসব পণ্য বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং যেসব খাদ্যজাতীয় পণ্য ওজন ও পরিমাপ করে বিক্রি করা যায়, সেইসব পণ্যকেই রিবাউই পণ্য বিবেচনা করে তার উপর রিবা সংক্রান্ত হুকুম বিবেচনা করতে হবে।

[এই পর্বে রিবা আল ফাদল নিয়ে প্রথম ধাপের আলোচনা করা হল। পরবর্তী পর্বে এর দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ]  


ওয়াল্লাহু তা'আলা আ'লাম

আল্লাহ্‌র মনোনীত জীবন ব্যবস্থায় সুদ : পর্ব ৩ - রিবার পরিচয় ১

পর্ব ১: http://goo.gl/IhWcQi
পর্ব ২: http://goo.gl/juXI56 


আমরা গত পর্বে ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় ‘রিবা’ এর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছি। কুর'আন ও সুন্নাহ-এর অকাট্য দলীলের মাধ্যমে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, ইসলামে রিবাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো রিবার পরিচয় নিয়ে।

আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়টা জানা প্রয়োজন, তা হল ইসলামে রিবা শব্দটি একটি ব্যপক অর্থবোধক শব্দ। আমরা অনেকেই রিবা বলতে শুধু সুদ বুঝে থাকি। অর্থাৎ ইংরেজি Interest বা usury বুঝে থাকি। কিন্তু বাস্তব কথা হল রিবা শুধু সুদ শব্দে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আরো অধিক কিছুই বোঝায়। বিভিন্ন গ্রন্থে ফকীহগণ রিবা শব্দের ৫ রকম ব্যবহার উল্লেখ করেছেন।


  • সুদ। এ নিয়ে আলোচনা আসছে।

  • পণ্য বিনিময়ে বেশি/কম করা। এ নিয়েও আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

  • ক্রয়-বিক্রয়ে বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বনের খেত্রেও রিবা শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন, সূরা নিসার ১৬১ নাম্বার আয়াত “আর এ কারণে যে, তারা রিবা গ্রহণ করত, অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, তারা অপরের সম্পদ ভোগ করতো অন্যায় ভাবে।” এর তাফসীরে কতিপয় মুফাসসিরগণ ‘রিবা’র তাফসীর করেছেন ক্রয়-বিক্রয়ে অবৈধ পন্থা হিসেবে।

  • প্রতিদান পাওয়ার আশায় কাউকে কিছু দেয়ার ক্ষেত্রেও রিবা শব্দটি ব্যবহার হতে পারে। যেমন সূরা রূমের ৩৯ নাম্বার আয়াত “মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা ‘রিবা’তে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না” এর তাফসীরে অনেক মুফাসসির রিবাকে এই অর্থেই নিয়েছেন।

  • যে কোন হারাম কাজের ক্ষেত্রেও রিবা ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন ‘কানযুল উম্মাল’ এ একটি হাদীস পাওয়া যায়, যেখানে বলা হচ্ছে, “সবচাইতে নিকৃষ্ট রিবা হল এক ভাই আরেক ভাই এর মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করা।”

তবে শেষ তিন প্রকারে রিবা শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে কিংবা একেবারেই অপ্রচলিত।


আরবী ভাষায় ربا (রিবা) এর শাব্দিক অর্থ হল আধিক্য, বৃদ্ধি, অতিক্রম করা, আকার ও সংখ্যায় কোন কিছু বৃদ্ধি পাওয়া। আহকামুল কুর’আন গ্রন্থে ইবনুল আরাবী বলেন, “রিবার আভিধানিক অর্থ হল বৃদ্ধি।”

তাই ব্যবসা ও ক্রয়-বিক্রয়ে অতিরিক্ত নেবার ক্ষেত্রে কিছু কিছু অতিরিক্ত নেওয়াকে ইসলামে রিবা বলা হয় এবং তা হারাম করা হয়েছে। তবে সব প্রকার অতিরিক্ত গ্রহণই রিবা নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু প্রকার অতিরিক্ত গ্রহণই হল রিবা।


ইসলামে ব্যবসা ও বিনিময় সংক্রান্ত মুয়ামালাতে রিবা মূলত দুই রকম।

১। রিবা আন–নাসি’আতু [ربا النسيئة]

২। রিবা আল-ফাদল [ربا الفضل]




রিবা আন–নাসি’আ [ربا النسيئة]


রিবা আন-নাসি’আকে অনেক ফকীহ রিবা আল-কুর’আন [ربا القران] হিসেবেও নামকরণ করেছেন কেননা এই ধরণের রিবার কথা সরাসরি কুর’আনে এসেছে।

এই প্রকারের সুদের সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য, সালাফ আস সালেহীনের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে সহজবোধ্য হয়ে যায়।


আলী (রা) বলেছেন,

“যে ঋণ লাভ টেনে আনে, তাই সুদ”। [আল ‘আযীযী (হাসান লি ঘাইরিহী), আসসিরাজুল মুনীর, মিসর]

ফুযালা ইবন উবাইদ (রা) বলেছেন, “যে ঋণ লাভ টেনে আনে, তা এক প্রকারের সুদ” [বাইহাকী]

ইমাম আবূ বাকর জাসসাস রাযী রিবা আন-নাসি’আকে রিবা আল-কুর’আন নামকরণ করে বলেন,

“মেয়াদের ভিত্তিতে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের শর্তে যে ঋণ দেয়া হয়, তাকে রিবা আল-কুর’আন বলে” [আহকামুল কুর’আন, মিসর]

ইবন জারীর বলেন,  “জাহিলী যুগে প্রচলিত ও কুর’আনে নিষিদ্ধ রিবা হল কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ দিয়ে মূলধনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করা।” [তাফসীর ইবন জারীর]


আরবী ভাষার সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত আবূ ইসহাক যাজ্জাজ রিবা আন নাসি’আকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে,

“প্রদত্ত ঋণের পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত উসূল করাই হল রিবা” [তাজুল ‘উরূস]



উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোকে সহজ করে বলতে গেলে যা দাঁড়ায় তা হল, ঋণ দিয়ে সেই ঋণ ফেরত নেবার সময় চুক্তি মোতাবেক কেউ যদি ১ পয়সাও অতিরিক্ত গ্রহণ করে, তবে সেই ১ পয়সা হবে রিবা আন-নাসি’আ। অর্থাৎ ঋণের মূলধনের সাথে কেউ যদি অতিরিক্ত কোন অর্থ আদায় করে, তবে সেটাই রিবা।

এখানে স্পষ্ট একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন, সেটি হল ইসলামে ঋণের ধারণা খুবই সহজ। ইসলামের ঋণের কোন অতিরিক্ত ফায়দা আসতে পারে না। অর্থাৎ কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয়, নির্দিষ্ট সময় পরেও সেই টাকা ফেরত নিতে গেলে তাকে ১০০ টাকাই ফেরত নিতে হবে। ১০১ টাকাও নিতে পারবেনা। এই কারণে ইসলামে ঋণের প্রকারভেদ একটাই। আর সেটা হল কারদ আল-হাসানা। ইসলামে এই কারদ আল-হাসানা ব্যতীত কোন প্রকার ঋণের স্থান নেই। অর্থাৎ ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত অর্থসহ তা ফেরত নেয়া ইসলামে কোন ক্রমেই জায়িয নয়, এবং কেউ যদি এইভাবে ঋণ ফেরত নিয়ে থাকে, তবে সেটা রিবা আন-নাসি’আ। যেমনটা আমরা সালাফদের সংজ্ঞা থেকে জানলাম। এখানে আরো বলে রাখা প্রয়োজন, আমরা আমাদের সমাজে সুদ বলতে যা বুঝি, তা মূলত রিবা আন-নাসি’আ। অর্থাৎ এক প্রকারের রিবা। রিবা মানেই শুধু সুদ নয়। বরং রিবা আন-নাসি’আ মানে সুদ।


উল্লেখ্য, ঋণের অতিরিক্ত আদায় রিবা হবে তখনই, যখন তা চুক্তিতে উল্লেখ করা থাকবে। কিন্তু চুক্তির বাইরে কেউ যদি স্বেচ্ছায়, উপহার হিসেবে কাউকে অতিরিক্ত দান করে, সেক্ষেত্রে তা হিবা বা গিফট হিসেবেই গণ্য হবে। রিবা নয়।


জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে আসি যখন তিনি মাসজিদে ছিলেন আর আমাকে বললেন, ‘দুই রাকাত পড়ে নাও’। আমি তার পাওনাদার ছিলাম, তাই তিনি আমার পাওয়া ফেরত দিলেন আর কিছু অতিরিক্তও দিলেন।” [বুখারী ৪৪৩]

এছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এক ব্যক্তির কাছে একটি বাচ্চা উট ধার নেন। ফেরত দেবার সময় সাহাবীরা ঐ বাচ্চা উটটি খুঁজে পেলেন না। পরিবর্তে পেলেন এমন একটি উট যা কিছুটা যৌবন প্রাপ্ত ও হৃষ্টপুষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বললেন, “(এটিকেই) দিয়ে দাও। তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে ধার শোধে উত্তম।” [বুখারী ২৩০৫]


হাদীসদ্বয় থেকে জানা যায়, এই অতিরিক্ত দান যদি চুক্তিতে উল্লেখ না থাকে, এবং তা দেনাদারের স্বেচ্ছায় ও খুশিতে হয়ে থাকে, তাহলে এই অতিরিক্ত প্রদান-গ্রহণ করা জায়িয। আর যদি চুক্তি করা থাকে, যে ফিরিয়ে দেবার সময় কিছু অতিরিক্ত দিতে হবে, তবে সেটা রিবা আন-নাসি’আ এবং তা হারাম।


আরো বিস্তারিতভাবে বলা যায়, যদি কোন ব্যক্তি কাউকে ঋণ দেবার সময় এই বলে ঋণ দেয়, যে ফেরত দেবার সময় অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে, তাহলে এই অতিরিক্ত হল রিবা আন নাসি’আ। আর যদি কোনরূপ কিছুই বলা না থাকে বা চুক্তি করা না থাকে, অর্থাৎ কারদ আল-হাসানা দেয়, কিন্তু ঋণ গ্রহীতা নিজ খুশিতেই ফেরত দেবার সময় উত্তম কিছু বা অতিরিক্ত কিছু দেয়, তাহলে এটি রিবা নয়।



[এই পর্বে রিবা আন-নাসি’আ নিয়ে আলোচনা করা হল। পরবর্তী পর্বে রিবার দ্বিতীয় প্রকার – রিবা আল-ফাদল নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্‌]


এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞানী

আল্লাহ্‌র মনোনীত জীবন ব্যবস্থায় সুদ : পর্ব ২ – সুদ ও ইসলাম

[প্রথম পর্বের লিংক: http://goo.gl/IhWcQi] 


আমরা গত পর্বে জেনেছি ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল সম্পদের সুষম বন্টন। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অর্থনীতির তত্ত্ব যদিও সেই কথাই বলে, তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, সম্পদ কেবল বিত্তশালীদের হাতেই ঘুরপাক খায়। অথচ সম্পদ যাতে শুধুমাত্র বিত্তশালীদের হাতে পুঞ্জিভূত না হয়, সেটার দিকেই মূল লক্ষ্য রাখে ইসলামি অর্থনীতি। আল্লাহ্‌ তা’লা বলেন,


"আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।" [সূরাহ হাশর: আয়াত ৭]


আর এই সম্পদের সুষম বন্টনের ক্ষেত্রে প্রধান যে বাধার মুখোমুখি হতে হয়, তা হল সুদ। সুদ এমনই একটি মারাত্মক জুলম, যা বিত্তশালীদের পকেট ভারী করে সাধারণ জনতাকে পথে বসিয়ে দেয়। সুদের বাস্তবিক অপকারিতা নিয়ে ইনশাআল্লাহ্‌ বিস্তারিত আসবে পরবর্তী পর্বগুলোতে।

ইসলামি অর্থনীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল, এটি সুদ অস্বীকার করে। সুদের অস্তিত্ব বিলীন করতে চায় এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করে। অথচ আমাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে সুদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই ইসলামে সুদের ব্যপারে কী বলা হয়েছে, কীভাবে সুদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, কোন পর্যায়ে একে হারাম করা হয়েছে, আমাদের বর্তমান সুদী ব্যবস্থা এর সাথে কতটা যুক্ত, সে সংক্রান্ত জ্ঞান আহরণ করা প্রত্যকে ঈমানদার মুসলিমের উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সুদের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম যদি দেখা হয়, তাহলে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট আদেশ লক্ষ্যণীয়।



কুরআন মাজিদ সুদ

সুদের ব্যপারে আল্লাহ্‌ সুবহানাহুওয়া তা’লা কুরআনে একাধিক আয়াত নাযিল করেছেন। এইসব আয়াতে দেখার বিষয় হল, আল্লাহ্‌ আযাযা ওয়া জাল সুদকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি এবং কঠোর ভাষায় হারাম ঘোষনা করে দিয়েছেন। কোন অবস্থাতেই আমরা সুদকে হালাল করার সুযোগ পাচ্ছি না।


“মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে।“ [সূরাহ আর রূম: আয়াত ৩৯]

“বস্তুতঃ ইহুদীদের জন্য আমি হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র বস্তু যা তাদের জন্য হালাল ছিল-তাদের পাপের কারণে এবং আল্লাহর পথে অধিক পরিমাণে বাধা দানের দরুন। আর এ কারণে যে, তারা সুদ গ্রহণ করত, অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, তারা অপরের সম্পদ ভোগ করতো অন্যায় ভাবে। বস্তুত; আমি কাফেরদের জন্য তৈরী করে রেখেছি বেদনাদায়ক আযাব।” [সূরাহ আন নিসা: আয়াত ১৬০ -১৬১]

“ঈমানদারগণ! তোমরা সুদের উপর সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পারো।” [সূরাহ আলি ইমরাআন: আয়াত ১৩০]

“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছেঃ ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লা’হ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৫]

“আল্লাহ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৬]

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৮]

“অতঃপর যদি তোমরা (সুদ) পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৭৯]


সুদের সাথে এইভাবেই সরাসরি সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন আল্লাহ্‌। বর্তমান সুদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতার ওপর যদি ঋণ পরিশোধ কোন কারণে কষ্টকর হয়ে যায়, তাহলে ফাইনান্স হাউসগুলো তাকে ছাড় দেয় না। মর্টগেজ বা বন্ধক বিক্রি করে তারা সুদ ও আসল তুলে নিয়ে আসে। অথচ আল্লাহ্‌ বলছেন,


“যদি কেউ যদি অভাবগ্রস্থ হয়, তবে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম যদি তোমরা উপলব্ধি কর।” [সূরাহ আল বাক্কারা: আয়াত ২৮০]


লক্ষ্য করুন, ঋণ পরিশোধের সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ঋণ দাতার অবশ্যই দাবি থাকে সেই ঋণের ওপর এবং বর্তমান ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতার লেপ কম্বল বিক্রি করে হলেও সুদ আদায় করা হয়। কিন্তু আল্লাহ্‌ বলছেন তাকে সময় দিতে! কোন অবস্থাতেই যাতে তাকে অতিরিক্ত উসুল বা সুদের খপ্পরে পড়তে না হয়। যদিও ইসলামি ঋণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সুদমুক্ত।

তাই কুরআন মাজিদের আলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সুদের ব্যপারে এক বিন্দু ছাড় দেয়া সম্ভব নয়।



হাদীস সুদ

কুরআন এর আয়াতের আলোকে রাসূলুল্লাহ [] একাধিকবার সুদের ব্যাপারে এই উম্মাহকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। দিয়েছেন অভিশাপ ও ভয়ঙ্কর শাস্তির খবর।


রাসূল সেই নারীকে অভিশাপ দিয়েছেন যে ট্যাটু আঁকা চর্চা করে এবং সেই নারী যে ট্যাটু আঁকায়, এবং সেই ব্যক্তি যে সুদ ভক্ষণ করে এবং যে সুদ দেয়।  [সহীহ আল বুখারী : ৫৩৪৭]

আল্লাহ্‌র রাসূল অভিশাপ দিয়েছেন সুদ গ্রহীতা, সুদ দাতা, সুদের হিসাবরক্ষের এবং এ ব্যাপারে সাক্ষ্যদানকারীর ওপর আর বলেছেন “ওরা সকলেই সমান” [সহীহ মুসলিম ১৫৯৭]

সুদের ৭৩ টি অপকারিত রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বনিম্ন হল আপন মায়ের সাথে জিনা/ব্যভিচার করা।  [সুনান ইবন মাজাহ : ২২৭৪ {হাসান হাদীস (দারুস সালাম)। সোর্স: Sunnah.com}] 

রাসূল বলেন, “তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্তু থেকে বেচে থাকো।” সাহাবীগণ বললেন, “হে আল্লাহ্‌র রাসূল! সেগুলো কী?” তিনি উত্তরে বললেন, “আল্লাহ্‌র সাথে শিরক করা,জাদু করা,অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ্‌ হারাম করেছেন, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ গ্রাস করা, যুদ্ধের সময় পলায়ন করা, সতী-সাধ্বী নিরীহ ঈমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা।”  [সহীহ আল বুখারী : ৬৮৫৭]

আল্লাহ্‌র রাসূল যে ব্যক্তি সুদ নেয় ও যে ব্যক্তি সুদ দেয়, তাদের অভিশাপ দিয়েছেন [সহীহ মুসলিম : ১৮:১০৫]

আল্লাহ্‌র রাসূল বলেন, এমন একটি সময় আসবে, যখন সুদ খাবেনা এমন কেউ থাকবেনা, আর কেউ যদি সুদ নাও খায়, তবু এর ধূলোবালি থেকে রক্ষা পাবে না। [ইবন মাজাহ, আবু দাউদ, আল জামি’আল আসগার {সুয়ুতী, পৃষ্ঠা ৭৫৩১ : সহীহ (সোর্স: hdith.com)}]


রাসূল [] এর হাদীস থেকেও দেখা যাচ্ছে সুদের হারাম হবার কথা। উল্লিখিত সহীহ হাদীসগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য হাসান পর্যায়ের ও কিছু দুর্বল বর্ণনার হাদীসও রয়েছে, যাতে বর্ণিত হয়েছে সুদের ভয়ানক পরিণতির কথা। কোনটায় আল্লাহ্‌র রাসূল []  বলেছেন তিনি মিরাজের সময় সুদখোরদের পেটে সাপ কিলবিল করতে দেখেছেন, কোনটায় তিনি বলেছেন একজন মুসলিমের এক দিরহাম সুদ গ্রহণ করা ৩৩ বা ৩৬ বার ব্যভিচার/জিনা করার চাইতেও জঘন্য।



ইসলাম সুদ

কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কোন মুসলিমের পক্ষে সুদকে হালাল ভাবার কোন সম্ভাবনা ও সুযোগ নেই। ইসলামে অত্যন্ত জঘন্য একটি স্থান দখল করে আছে সুদ। ভেবে দেখুন, কেউ তার জন্মদাত্রী মায়ের সাথে ব্যভিচার করতে পারে কি? সম্ভব? অথচ সুদ খাওয়ার ৭৩ টি গুনাহ এর সর্বনিম্ন গুনাহ হল সেই ব্যক্তির গুনাহ এর সমান, যে তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের সাথে জিনা করে।

ভেবে দেখুন তো, কেউ একই দিনে ৩৬ বার জিনা করে ফেলেছে! কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার গুনাহ? তার শাস্তি? অথচ এক দিরহাম সুদ গ্রহণকে ৩৬ বার জিনা করার চাইতেও জঘন্যতর আখ্যা দেয়া হয়েছে।

তাহলে আমাদের কি এতটুকু সতর্ক হবার প্রয়োজন নেই? আমাদের কি এতটুকু ভীত হবার দরকার নেই? আমাদের এতটুকু চিন্তা করার অবকাশ নেই যে আমরা সুদকে কীভাবে নিচ্ছি?

আসুন আমরা নিজেদের চারটি প্রশ্ন করি।

- আমরা কি সুদ নিচ্ছি?
- আমরা কি সুদ দিচ্ছি?
- আমরা কি সুদী কারবার লিখে রাখছি?
- আমরা কি সুদী কারবারে সাক্ষী থাকছি/ভূমিকা রাখছি?

এই চার শ্রেণীর মানুষকেই আল্লাহ্‌র রাসূল [] অভিশাপ দিয়ে বলেছেন এরা সবাই একই গুনাহগার!

আমরা অনেকেই হয়তো নামায পড়ি, রোজা রাখি, কুরআন পাঠ করি, চেষ্টা করি হারাম কিছু না করতে, অথচ ঠিকই এমন ভাবে সুদী কারবারে জড়িয়ে পড়ছি, যেন এটা কোন বিষয়ই নয়!

অথচ যে ব্যক্তি হারাম উপার্জন করে তা দিয়ে উদরপূর্তি করে, তার দু’আ কিংবা ইবাদাত কবুলই হয় না! রাসূলাল্লাহ [] বলেন,


‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।’’ আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।’’ অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছেঃ হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ!  সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?’’ [সহীহ মুসলিম : ১০১৫]

আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম। [জামি’ আত তিরমিদি : ৬১৪ {হাসান হাদীস: দারুস সালাম (সোর্স: Sunnah.com)} ]


স্কলারদের মতে যে শরীর হারাম উপার্জনে পুষ্টি লাভ করে, সে শরীর আল্লাহ্‌র নিকট অপবিত্র। ফলে তাঁর ইবাদত কী উপায়ে কবুল করে পারে?


স্পষ্টতই সুদের ব্যাপারে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল [] অত্যন্ত কঠোর নীতি অবলম্বন করেছেন। যে ব্যক্তি সুদের সাথে সম্পর্ক রাখে, আল্লাহ্‌ তা’লা বলেছেন সে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও রাসূলুল্লাহর [] সাথে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মুসলিম কখনই আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের [] সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা সুদূর কল্পনাতেও আনবেন না। কিন্তু সুদী কারবারে লিপ্ত হয়ে অনেকেই প্রতিনিয়ত আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের [] বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন।

একজন মুসলিমের কাছে আল্লাহ্‌র আদেশ ও নিষেধের বাইরে কোন কিছুই বলার থাকে না, কোন কিছুই করার থাকে না। একজন মুসলিম সেটাই মেনে নেবে যা আল্লাহ্‌ আদেশ করেছেন। আর সেখান থেকেই দূরে থাকবে যা আল্লাহ্‌ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্‌ বলেন,

"আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট তায় পতিত হয়।" [সূরাহ আল আহযাব : আয়াত ৩৬]

অর্থাৎ আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূল [] যখন কোন বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন, তখন মু’মিন পুরুষ ও নারী কারোরই কোন এখতিয়ার নেই সেখানে দ্বিমত পোষণ করার।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’লা সুদকে হারাম করেছেন তো আমরাও মেনে নেব। কোন প্রশ্ন ছাড়া। কোন তর্ক ছাড়া। আল্লাহ্‌ মুসলিমদের পরিচয় কুরআনে এভাবেই দিয়েছেন,


তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। [সূরাহ নূর : আয়াত ৫১]


[এ পর্বে আমাদের আলোচনা ছিল সুদের হারাম হবার হুকুমের ওপর পরবর্তী পর্বে সুদ ও রিবা এর সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্‌।]  


এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞানী 

আল্লাহ্‌র মনোনীত জীবন ব্যবস্থায় সুদ : পর্ব ১ - জীবন ব্যবস্থা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

 
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা - এই বিষয়টা প্রতিটি মুসলিমই কম বেশি উল্লেখ করে থাকেন, বলে থাকেন, লিখে থাকেন। কিন্তু বুঝে থাকেন কজন, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করার সুযোগ রয়ে যায়। কারণ জীবন ব্যবস্থা বা লাইফ সিস্টেমের কিছু সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা বলে দাবি করার সাথে সাথে অনুধাবন ও অনুসরণ করা জরুরী। অল্প ভাষায় বিস্তর বলা সম্ভব না হলেও যা উল্লেখ করা সম্ভব, তা হল যে কোন জীবন ব্যবস্থাই একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনে কিছু কোড বা নিয়ম কানুন সেট করে দিয়ে থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবন যাপনের নিয়ম, পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে কিছু গৃহীত নিয়ম বা এক্সেপ্টেড নর্মস সেই জীবন ব্যবস্থায় ডিফল্ট হিসেবে থেকে থাকে। তাই ইসলামকে আমরা যখন জীবন ব্যবস্থা রূপে ঘোষণা করছি, তখন আমাদের বুঝে থাকা জরুরী, যে এইসব উপরোল্লিখিত বিষয়ে ইসলামের কোন নিয়ম, পরামর্শ কিংবা গাইডলাইন আছে কিনা।

এক্ষেত্রে, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’লা কুরআনে উল্লেখ করেছেন,

“নিশ্চই আল্লাহ্‌র নিকট (গ্রহণযোগ্য/অনুমোদিত) জীবন ব্যবস্থা হল ইসলাম” [সূরাহ আলি ইমরান: আয়াত ১৯]


অর্থাৎ, বিচিত্র ধারার অসংখ্য জীবন ব্যবস্থাসমূহের মাঝে, আল্লাহ্‌ তা’লা কেবল মাত্র একটি জীবন ব্যবস্থাকেই রিকগনাইজ করেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, আল্লাহ্‌র কাছে দাম রাখে, গ্রহণযোগ্যতা রাখে শুধুমাত্র একটি জীবন পন্থা। আর তা হল ইসলাম।

অন্য আয়াতে আল্লাহ্‌ বলছেন,

“যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য জীবন ব্যবস্থা খোঁজ করবে, কোনদিনই তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত” [সূরাহ আলি ইমরান: আয়াত ৮৫]


অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া আর কোন জীবন ব্যবস্থা মেনে চলা ব্যক্তির আখিরাতে ক্ষতি ব্যতীত কিছু পাওনা নেই। তার সেই জীবন ব্যবস্থা আল্লাহ্‌ কখনই, কোন অবস্থাতেই গ্রহণ করবেন না।

যারা ইসলামকে সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন, তারা জানেন, ইসলাম মানব জীবনের কোন একটি স্তর, পর্যায় কিংবা ক্ষেত্র বাকি রাখে নি, যেখানে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত কোন গাইড লাইন প্রদান করা হয় নি। কিভাবে নখ কাটতে হয় থেকে শুরু করে কিভাবে শ’খানেক রাজ্যকে একজন শাসকের অধীনে নিয়ে এসে সমস্ত পৃথিবী শাসন করতে হয় পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ে ইসলাম দেখিয়েছে পথ। জ্বেলেছে আলোকবর্তিকা।

তাই বলা বাহুল্য, ইসলামের একটি অর্থনৈতিক দর্শনও রয়েছে। রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ইসলামের বিভিন্ন শাখা প্রশাখার মধ্যে অন্যতম বিশদ, বিস্তর ও সুবিশাল শাখা হল ইসলামি অর্থনীতি। একজন মুসলিম হিসেবে, আমাদের অতি অবশ্যই ইসলামের অর্থনৈতিক মৌলিক তত্ত্ব, বাস্তবিক প্রয়োগ, সমাধান ও নির্ধারিত নিয়ম কানুন সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং অন্যান্য প্রচলিত অর্থনৈতিক পদ্ধতির সাথে ইসলামি অর্থনীতির পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও হারাম হালাল সম্পর্কে সজাগ থাকা
জরুরী। আমরা যেমন মুসলিম হিসেবে খৃষ্টানদের রীতিতে আল্লাহ্‌র ইবাদত করতে পারি না কিংবা বৌদ্ধদের রীতিতে বিয়ে করতে পারি না, ঠিক সেভাবেই আমরা ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন নিয়মে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সমাধা করতে পারি না, যদি তা ইসলামের সাথে মৌলিক ভাবে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে।

ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা। এই কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেই রাসূল [] এর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে খিলাফত রাষ্ট্র পর্যন্ত অর্থনীতি পরিচালিত হয় ইসলামি অর্থনীতির মাধ্যমে। খিলাফতের পতনের পর থেকে অবধারিত ভাবে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রজ্বলিত আলোও স্তিমিত হয়ে আসে। ফলে দীর্ঘ শত বছর ধরে মুসলিম ভূমিগুলোতে অর্থ ব্যবস্থা দখল করে নিয়েছে প্রথমত সমাজতান্ত্রিক ও পরবর্তীতে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা। উভয়ের মৌলিক ধারনাই ইসলামের ঘোর বিরোধী। কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ে মুসলিম জাতি এইসব মানবসৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রথা ও ব্যবস্থায় নিমজ্জিত হওয়ার দরুন ইসলামের মৌলিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বেখবর হয়ে পড়েছে। ফলে ইসলামি অর্থনীতির প্রসঙ্গ তাদের কাছে নতুন কোন ফিলোসফি রূপে ধরা দেয়, অথচ এটা সেই ব্যবস্থা যা শত শত বছর ধরে কার্যকররূপে প্রচলিত ছিল এবং বর্তমান ক্যাপিটালিস্টিক ইন্টারেস্ট বেইসড সমাজের মত এর মেরুদন্ড কখনই ভেঙ্গে পড়ে নি।

অর্থনীতির মৌলিক উদ্দেশ্যের ব্যাপারে প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ Richard Theodore Ely বলেন,


"Economics is a science, but something more than a science, a science that though with the infinite variety of human life, calling not only for systematic, ordered thinking , but human sympathy, imagination, and in an unusual degree for the saving grace of commonsense."

অর্থাৎ, অর্থনীতি কেবল একটি বিজ্ঞানই নয়, এটি কেবলমান্ত সুসংবদ্ধ, সুশৃঙ্খলিত চিন্তার আবেদনই জানায় না, মানুষের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করতে ও বাস্তব জ্ঞান অসাধারণ পরিমান সম্প্রসারণ করতেও তা সচেষ্ট।

রাজনৈতিক অর্থনীতির জনক নামে খ্যাত স্কটিশ অর্থনীতিবিদ Adam Smith বলেছিলেন

 "Economics is the science of wealth."

অর্থাৎ অর্থনীতি হল সম্পদের (বন্টন) বিজ্ঞান।

অর্থনীতি বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল মেমোরিয়াল পুরস্কার প্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ Paul A. Samuelson এর মতে,

"Economics is the study of how men and society choose, with or without the use of money, to employ scarce productive resources which could have alternative uses, to produce various commodities over time and distribute them for consumption now and in the future amongst various people and groups of society."

অর্থাৎ স্বল্প সম্পদ কি করে অর্থ ব্যবহার করে কিংবা না করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে বন্টন করা যায়, সে সংক্রান্ত বিদ্যাই হল অর্থনীতি।