সকাল থেকে একটা অনুশোচনা আর আফসোসের
সূঁচ ক্রমাগত হৃদয়কে বিদ্ধ করে চলেছে। রাশেদ কী নির্বিকার চিত্তে বললো
কথাগুলো, “তোমার এইসব মোরাল আর ভ্যালুজ এর কোনো দাম নেই, তুমি নিজেই এসবের
দাম দাও না। শুধু সুযোগ বুঝে কাজে লাগাও.. আর আমি একদিন করতে বললেই
সমস্যা।”
কীভাবে পারলো বলতে?
সাড়ে তিন বছরের সংসার। কোনোদিন কি রাশেদ মৌরিতাকে ওর হিজাব করার ব্যাপারে সাহায্য করেছে? সে নিজেই তো একা একা যতোটা পারে মেইন্টেইন করেছে বরাবর।
হ্যাঁ, বিয়ের সময় কিছুটা ছাড় সে দিয়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে তখন। হঠাৎ দেখাদেখি, দুই পক্ষের পাকা কথা, দিনক্ষণ মেলানো। চিন্তায়-ভাবনায়, চাওয়া-পাওয়ায় এত মিল সহজে পাওয়া যায় না। দুই পরিবারের সবাই রাজি, সবাই খুশি! রাশের ওই পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে আর মৌরিতা এই পরিবারের প্রথম সন্তান হওয়ায় আমোদ-আহ্লাদটা দু পক্ষেরই মাত্রাছাড়া। আর আয়োজনটাও তেমনই জমকালো, মনে রাখার মতো।
এত হুলুস্থূল বিয়েতে সবাই পরী সেজে থাকবে আর মেয়ে খালাম্মার মত ঢেকেঢুকে থাকবে তা কি হয়? মৌরিতার মা আর খালারা প্রথম থেকেই চাপাচাপি করছিল হিজাব ছাড়া থাকার জন্য। প্রথম প্রথম ওর একটুও ইচ্ছা করে নি। সারাবছর সাদাসিধে চলা মেয়ে ও, এত সাজগোজ, দেখানো স্বভাবটা অসহ্য লাগে। তাই বলে বিয়ের দিনেও এভাবে থাকবে? তোর চেয়ে তো তোর খালাকে বেশি সুন্দর লাগবে দেখতে। হিজাব করলে কি মানুষের কোনো শখ থাকতে নেই? একদিন হিজাব না করলে কী এমন হবে? কত রকম কথা। বান্ধবীরা ওভার-স্মার্টনেসের দিক থেকে আরও কয়েকশ ধাপ এগিয়ে, হিজাবের সাথে বিয়ের শাড়ি পরলে নাকি দেখতে বুড়ি-বুড়ি, আনস্মার্ট, আর গেয়ো ভুতের মত লাগবে দেখতে!
মানুষের মন বোঝা দায়। মৌরিতারও কি ছাই ইচ্ছা করেনি হিজাব-ছাড়া থাকতে? হৃদয়ের গোপন একটা প্রকোষ্ঠে ওরও এমন একটা ইচ্ছা যে হয় নি তা না। কিন্তু তবুও মনে হতো-- কাজটা ঠিক হবে না। এতদিন যে বিশ্বাস, নীতি আর আদর্শের ওপর নিজেকে অটল রেখেছে, সেখান থেকে হুট করে একদিনের জন্য সরে দাঁড়ানো একটা চরম পর্যায়ের বোকামি হবে। একদিনের জন্য হিজাবে ছাড় দেওয়াটার কোনো যুক্তিই নেই।
কিন্তু মন মানলো না। আস্তে আস্তে তার অনিচ্ছাটা দ্বিধায় পরিণত হতে থাকলো। শেষে অজান্তেই নিজের সামনে কিছু অপশন তুলে দিলো সে, নিজেকে ছাড় দেওয়া জন্য কতোগুলো অজুহাত মাত্র- বিয়ের দিন কি হিজাব করবো নাকি করবো না? শুধু স্কার্ফটা কি পরবো? আচ্ছা, যদি শাড়ির সাথে ভালো না লাগে তাহলে ছোট হাতা ব্লাউজটাই নাহয় পরবো…
বিয়ের দিন কীভাবে যেন হিজাব না করানোর জন্যই সবকিছু জোট বেধে ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগলো। ব্লাইজের কাপড়টা দিয়ে কোনোমতেই ফুল হাতা হবে না দর্জি সাফ জানিয়ে দিলো। একরঙা কাপড় এনে বড়ো হাতা ব্লাউজ বানানো যেতো, কিন্তু তখনই সব আলস্য আর উদাসিনতা পেয়ে বসলো মৌরিতার। সারাদিন বাইরে টো-টো করে ঘুরে শাশুড়ি আর ননদের সাথে মিলে এই শাড়িটা পছন্দ করে কিনেছে, তার সাথে একরঙা সাধারণ একটা কাপড়ের জোড়া দেওয়া ফুলহাতা পরলে কি মানাবে, শাশুড়িই বা কী মনে করবে? এইসব হাবিজাবি শত চিন্তা করতে করতে ছোট হাতা ব্লাউজই বানিয়ে ফেললো। এরপর ছোট হাতা ব্লাউজের সাথে মাথায় স্কার্ফ পরলে কেমন দেখাবে সেই অস্বস্তিতে স্কার্ফটাও পরলো না। বান্ধবী কেয়া নতুন নতুন ফটোগ্রাফি ক্লাবে জয়েন করেছে। তাকেই বলেছিল সুন্দর সুন্দর কয়েকটা ছবি তুলে দিতে, গ্রুপ ফটো তোলার লোকের তো অভাব নেই, স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছবিগুলো যেন কেয়াই তোলে। কিন্তু কেয়া আবার ওর ক্লাব থেকে সিনিয়র ভাইকে ধরেবেঁধে আনলো- তার ছবির হাত নাকি অসাধারণ, বলিউড ফটো আর্টিস্টও ফেইল! ব্যস, মৌরিতাও গলে গেলো। স্বামী-স্ত্রীর ছবি তো বটেই, মৌরিতার ক্লোজ শটগুলিও তিনিই নিলেন। মেইক-আপঅলা ঝিকিমিকি চেহারার ছবি, গালে হাত-কোমড়ে হাত আকাবাঁকা পোজ দেওয়া ছবি, হিজাববিহীন পোশাকের খোলামেলা ছবি…
সেই হিজাববিহীন পোজ দেওয়া ছবিগুলোর কথা ভাবতেই আজকে মৌরিতার চোখ ঠেলে একগাদা বাষ্প দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসলো। ঘেন্নায় রি-রি করছে তার মন। কার প্রতি এত ঘৃণা তার? রাশেদের কথাগুলো রিপ্লে-তে দেওয়া মিউজিকের মতো অনন্তকাল ধরে মাথার মধ্যে বেজেই যাচ্ছে। “তোমার কোনো মোরাল-টোরাল নেই, যখন ভালো লাগে করো, আর যখন ইচ্ছা খুলে ফেলো। এগুলাকে ধর্ম করা বলে না, এগুলাকে বলে সুযোগ নেওয়া। হিজাবকে এতোই ভালোবাসলে বিয়ের দিন করতা না নাকি? ফেসবুকেও তো যখন-তখন হিজাব-ছাড়া ছবি শেয়ার দিচ্ছো, এখন একটা স্পেশাল অকেশনে রিকোয়েস্ট করলাম আর তোমার দশ রকম বাহানা… একটা দিনের জন্য এখন আর হিজাব ছাড়তে পারছো না, কত বড়ো বড়ো অফিসার আসবে আজকে তাদের বউটউ নিয়ে। বিয়ের সময় হাজার হাজার মানুষের সামনে ঠিকই ফ্যাশন শো করলা, এখন একটা অকেশনের জন্য কী হয় … ”
তাই তো। রাশেদ কি খুব মিথ্যে বলেছে? বিয়ের সময় হাজার লোকের আনাগোনা, সেই দিনটাতেই তো হিজাবে থাকার দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি। সে যদি সত্যিই আল্লাহর কথা ভেবে হিজাব করতো, তাহলে কি নিজেকে এতো খেলো করে দিতে পারতো? নিজের আত্মসম্মান আর লজ্জাবোধে কি একটুও আঘাত লাগতো না? শাশুড়ির মন জয় করার ধোঁয়া তুলে নিজের ব্যক্তিত্বকেই বিলিয়ে দিলো সে। তার শাশুড়ি অতটা না-বুঝ মানুষও তো ছিল না। শিক্ষিত মেয়ে মৌরিতা, শ্বশুরবাড়ির সবাই একনজরে পছন্দ করেছে দেখে। ও অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই তারা গুরুত্ব দিতেন। সত্যি বলতে মৌরিতার এখন মনে হচ্ছে যেন তখন সে নিজের বিশ্বাসের ওপর কাজ করলেই মানুষ তাকে আরও বেশি সম্মান করতো, তার মতামত ও কথার দাম দিতো, বুঝতো যে ওর শিক্ষাটা কেবল সার্টিফিকেট সাঁটা শিক্ষা নয়, বরং মনের ভেতর থেকেই ও একজন আলোকিত মানুষ।
বিয়ের পরেও ঘোরাঘুরি করতে গিয়েও বিভিন্ন সময়ে অনেক ছাড় দিয়েছে। হানিমুনের সময় তো হিজাবের কথা মনেই ছিল না। দুই-একজন পুরোনো বান্ধবী জিজ্ঞেস করেছিল অবশ্য, দায়সারা একটা উত্তর দিয়ে মৌরিতা ওদেরকে পাশ কাটিয়েছে। “তোর চরকায় তেল দে।” কিন্তু মনে মনে ভীষণ দাগ কাটতো ওদের কথাগুলো। প্রাণপণে মাথা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতো চিন্তাটাকে, আর কদিন পরেই হিজাব করবো এই যুক্তিই নিজেকে দিতো সে বারবার। কিন্তু এখন করতে কী সমস্যা? এই প্রশ্নের জবাব কখনোই নিজের কাছে দেওয়া হয় নি।
সুযোগ আর সামর্থ্য একসাথে খুব কমই মেলে। হবু শ্বশুরবাড়িকে রাজি করানোর মত সুযোগ আর বুদ্ধি দুটোই মৌরিতার ছিল। রাশেদের পরিবার ওর কোন কথাটা রাখে নি? বিয়ের সময় যেমন যেমন কাপড়ের সেট আর গহনার ডিজাইন চেয়েছে, ঠিক সেগুলোই কিনেছে। হিজাবটা সে বিয়ের দিন করতে চাইলে সে সুযোগ নিশ্চয়ই ছিল। হয়তো একটু কাঠখড় পোড়াতে হতো, তাও তো চেষ্টা করে দেখতে দোষ ছিল না। এখন আর সেই দিনগুলো ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা নেই। সঠিক কাজটা করার সময় আগেই পার হয়ে গেছে। এখন তো প্রায় সব ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলোতেও সে হিজাব ছাড়াই চলে যায়। মানুষটা তার হিজাবের গুরুত্ব কীভাবেই বা বুঝবে? বন্ধু-বান্ধবীদের দেখাদেখি দু-চারটে ছবি মৌরিতা এখন সবার সাথে শেয়ার করে। সে সবে হিজাব নেই। এত শো-অফ করা তার ধাচে নেই, অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় সমানে-সমান কখনোই যেতে পারবে না জানে, তারপরও স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে কয়েকটা ভালো ছবি দেখাতে ইচ্ছে করে। রাশেদের খোঁচা দেওয়া কথাগুলোর সমস্ত ঝাল এখন নিজের ওপর ঝাড়তে ইচ্ছে করছে। দুঃখের ব্যাপার হলো, মানুষ নিজের ওপর রাগ ঝাড়তে পারে না।
দুঃখিনী মৌরিতা চোখে জল নিয়েই আয়নার সামনে সাজতে বসলো। মেয়েরা মনের জল গোপন করেও হাসতে পারে। আজ সন্ধ্যায় পার্টি। রাশেদের বসের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। মৌরিতা আজ হিজাব করলে রাশেদ কিছুতেই খুশি হবে না। অভ্যস্ত হাতে সব করে যাচ্ছে সে। অথচ মনটা ব্যথায় অবশ হয়ে আছে। সাড়ে তিন বছরের সংসার। রাশেদের জন্য সব করতে পারে মৌরিতা, তবু সে কি সুখী? সব ছেড়েও কি রাশেদের মন জয় করতে পেরেছে সে? রাশেদ কি তাকে একজন মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে শিখেছে?
কাজল, আইলাইনার, লিপস্টিক সব নিখুঁতভাবে হয়েছে। তার সাজার হাত চমৎকার। কিন্তু এত সেজেও কীসের যেন কমতি। আত্মগ্লানি, অনুশোচনা, লজ্জা, অপমান তাকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিচ্ছে। জানালা দিয়ে হু-হু একটা বাতাস এসে মৌরিতার আয়রন করা চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। চোখের জলে কাজল লেপটে একাকার হয়ে গেলো সাজানো চেহারা। কী মনে করে ধুম করে উঠে গেলো মৌরিতা।
মাথায় যেন কিচ্ছু নেই। একটা স্বর ভেসে ভেসে তাকে শুধু বলছে - ওয়াশরুম, ওয়াশরুম। রাশেদ খুশি হবে না জানে, তবু আজকে তাকে কাজটা করতেই হবে। বরং অনেক আগেই করা উচিত ছিল। আজ সে কোনো মেইক-আপ করবে না। পরিপূর্ণ হিজাব করবে। এখন থেকে সমস্ত অনুষ্ঠানেই সে পরিপূর্ণ হিজাব করবে। কক্ষণো আর হিজাব ছাড়ার মত ভুল করবে না। যার যা খুশি তাকে নিয়ে ভাবুক। এতদিন সংসারের জন্য অনেক করেছে, স্বামী-সংসারের বাহানা করে নিজের আত্মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর থেকে সরে গিয়েছে যোজন যোজন দূরত্বে। তাতে কোনো লাভ হয় নি। পাপের আনন্দ দুই দিনের, অনুতাপটা চিরকাল তাড়া করে ফেরে। মৌরিতার বুক চিরে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, হে আল্লাহ, অনেক ভুল করেছি। এবার আমাকে ক্ষমা করো, এবার আমায় পথ দেখাও…
কলের ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা আর চোখের উষ্ণ জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মৌরিতা, তুমি সুখী হও।
সংকলিত লেখা
লেখক এর লিঙ্ক এখানে
কীভাবে পারলো বলতে?
সাড়ে তিন বছরের সংসার। কোনোদিন কি রাশেদ মৌরিতাকে ওর হিজাব করার ব্যাপারে সাহায্য করেছে? সে নিজেই তো একা একা যতোটা পারে মেইন্টেইন করেছে বরাবর।
হ্যাঁ, বিয়ের সময় কিছুটা ছাড় সে দিয়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে তখন। হঠাৎ দেখাদেখি, দুই পক্ষের পাকা কথা, দিনক্ষণ মেলানো। চিন্তায়-ভাবনায়, চাওয়া-পাওয়ায় এত মিল সহজে পাওয়া যায় না। দুই পরিবারের সবাই রাজি, সবাই খুশি! রাশের ওই পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে আর মৌরিতা এই পরিবারের প্রথম সন্তান হওয়ায় আমোদ-আহ্লাদটা দু পক্ষেরই মাত্রাছাড়া। আর আয়োজনটাও তেমনই জমকালো, মনে রাখার মতো।
এত হুলুস্থূল বিয়েতে সবাই পরী সেজে থাকবে আর মেয়ে খালাম্মার মত ঢেকেঢুকে থাকবে তা কি হয়? মৌরিতার মা আর খালারা প্রথম থেকেই চাপাচাপি করছিল হিজাব ছাড়া থাকার জন্য। প্রথম প্রথম ওর একটুও ইচ্ছা করে নি। সারাবছর সাদাসিধে চলা মেয়ে ও, এত সাজগোজ, দেখানো স্বভাবটা অসহ্য লাগে। তাই বলে বিয়ের দিনেও এভাবে থাকবে? তোর চেয়ে তো তোর খালাকে বেশি সুন্দর লাগবে দেখতে। হিজাব করলে কি মানুষের কোনো শখ থাকতে নেই? একদিন হিজাব না করলে কী এমন হবে? কত রকম কথা। বান্ধবীরা ওভার-স্মার্টনেসের দিক থেকে আরও কয়েকশ ধাপ এগিয়ে, হিজাবের সাথে বিয়ের শাড়ি পরলে নাকি দেখতে বুড়ি-বুড়ি, আনস্মার্ট, আর গেয়ো ভুতের মত লাগবে দেখতে!
মানুষের মন বোঝা দায়। মৌরিতারও কি ছাই ইচ্ছা করেনি হিজাব-ছাড়া থাকতে? হৃদয়ের গোপন একটা প্রকোষ্ঠে ওরও এমন একটা ইচ্ছা যে হয় নি তা না। কিন্তু তবুও মনে হতো-- কাজটা ঠিক হবে না। এতদিন যে বিশ্বাস, নীতি আর আদর্শের ওপর নিজেকে অটল রেখেছে, সেখান থেকে হুট করে একদিনের জন্য সরে দাঁড়ানো একটা চরম পর্যায়ের বোকামি হবে। একদিনের জন্য হিজাবে ছাড় দেওয়াটার কোনো যুক্তিই নেই।
কিন্তু মন মানলো না। আস্তে আস্তে তার অনিচ্ছাটা দ্বিধায় পরিণত হতে থাকলো। শেষে অজান্তেই নিজের সামনে কিছু অপশন তুলে দিলো সে, নিজেকে ছাড় দেওয়া জন্য কতোগুলো অজুহাত মাত্র- বিয়ের দিন কি হিজাব করবো নাকি করবো না? শুধু স্কার্ফটা কি পরবো? আচ্ছা, যদি শাড়ির সাথে ভালো না লাগে তাহলে ছোট হাতা ব্লাউজটাই নাহয় পরবো…
বিয়ের দিন কীভাবে যেন হিজাব না করানোর জন্যই সবকিছু জোট বেধে ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগলো। ব্লাইজের কাপড়টা দিয়ে কোনোমতেই ফুল হাতা হবে না দর্জি সাফ জানিয়ে দিলো। একরঙা কাপড় এনে বড়ো হাতা ব্লাউজ বানানো যেতো, কিন্তু তখনই সব আলস্য আর উদাসিনতা পেয়ে বসলো মৌরিতার। সারাদিন বাইরে টো-টো করে ঘুরে শাশুড়ি আর ননদের সাথে মিলে এই শাড়িটা পছন্দ করে কিনেছে, তার সাথে একরঙা সাধারণ একটা কাপড়ের জোড়া দেওয়া ফুলহাতা পরলে কি মানাবে, শাশুড়িই বা কী মনে করবে? এইসব হাবিজাবি শত চিন্তা করতে করতে ছোট হাতা ব্লাউজই বানিয়ে ফেললো। এরপর ছোট হাতা ব্লাউজের সাথে মাথায় স্কার্ফ পরলে কেমন দেখাবে সেই অস্বস্তিতে স্কার্ফটাও পরলো না। বান্ধবী কেয়া নতুন নতুন ফটোগ্রাফি ক্লাবে জয়েন করেছে। তাকেই বলেছিল সুন্দর সুন্দর কয়েকটা ছবি তুলে দিতে, গ্রুপ ফটো তোলার লোকের তো অভাব নেই, স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছবিগুলো যেন কেয়াই তোলে। কিন্তু কেয়া আবার ওর ক্লাব থেকে সিনিয়র ভাইকে ধরেবেঁধে আনলো- তার ছবির হাত নাকি অসাধারণ, বলিউড ফটো আর্টিস্টও ফেইল! ব্যস, মৌরিতাও গলে গেলো। স্বামী-স্ত্রীর ছবি তো বটেই, মৌরিতার ক্লোজ শটগুলিও তিনিই নিলেন। মেইক-আপঅলা ঝিকিমিকি চেহারার ছবি, গালে হাত-কোমড়ে হাত আকাবাঁকা পোজ দেওয়া ছবি, হিজাববিহীন পোশাকের খোলামেলা ছবি…
সেই হিজাববিহীন পোজ দেওয়া ছবিগুলোর কথা ভাবতেই আজকে মৌরিতার চোখ ঠেলে একগাদা বাষ্প দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসলো। ঘেন্নায় রি-রি করছে তার মন। কার প্রতি এত ঘৃণা তার? রাশেদের কথাগুলো রিপ্লে-তে দেওয়া মিউজিকের মতো অনন্তকাল ধরে মাথার মধ্যে বেজেই যাচ্ছে। “তোমার কোনো মোরাল-টোরাল নেই, যখন ভালো লাগে করো, আর যখন ইচ্ছা খুলে ফেলো। এগুলাকে ধর্ম করা বলে না, এগুলাকে বলে সুযোগ নেওয়া। হিজাবকে এতোই ভালোবাসলে বিয়ের দিন করতা না নাকি? ফেসবুকেও তো যখন-তখন হিজাব-ছাড়া ছবি শেয়ার দিচ্ছো, এখন একটা স্পেশাল অকেশনে রিকোয়েস্ট করলাম আর তোমার দশ রকম বাহানা… একটা দিনের জন্য এখন আর হিজাব ছাড়তে পারছো না, কত বড়ো বড়ো অফিসার আসবে আজকে তাদের বউটউ নিয়ে। বিয়ের সময় হাজার হাজার মানুষের সামনে ঠিকই ফ্যাশন শো করলা, এখন একটা অকেশনের জন্য কী হয় … ”
তাই তো। রাশেদ কি খুব মিথ্যে বলেছে? বিয়ের সময় হাজার লোকের আনাগোনা, সেই দিনটাতেই তো হিজাবে থাকার দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি। সে যদি সত্যিই আল্লাহর কথা ভেবে হিজাব করতো, তাহলে কি নিজেকে এতো খেলো করে দিতে পারতো? নিজের আত্মসম্মান আর লজ্জাবোধে কি একটুও আঘাত লাগতো না? শাশুড়ির মন জয় করার ধোঁয়া তুলে নিজের ব্যক্তিত্বকেই বিলিয়ে দিলো সে। তার শাশুড়ি অতটা না-বুঝ মানুষও তো ছিল না। শিক্ষিত মেয়ে মৌরিতা, শ্বশুরবাড়ির সবাই একনজরে পছন্দ করেছে দেখে। ও অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই তারা গুরুত্ব দিতেন। সত্যি বলতে মৌরিতার এখন মনে হচ্ছে যেন তখন সে নিজের বিশ্বাসের ওপর কাজ করলেই মানুষ তাকে আরও বেশি সম্মান করতো, তার মতামত ও কথার দাম দিতো, বুঝতো যে ওর শিক্ষাটা কেবল সার্টিফিকেট সাঁটা শিক্ষা নয়, বরং মনের ভেতর থেকেই ও একজন আলোকিত মানুষ।
বিয়ের পরেও ঘোরাঘুরি করতে গিয়েও বিভিন্ন সময়ে অনেক ছাড় দিয়েছে। হানিমুনের সময় তো হিজাবের কথা মনেই ছিল না। দুই-একজন পুরোনো বান্ধবী জিজ্ঞেস করেছিল অবশ্য, দায়সারা একটা উত্তর দিয়ে মৌরিতা ওদেরকে পাশ কাটিয়েছে। “তোর চরকায় তেল দে।” কিন্তু মনে মনে ভীষণ দাগ কাটতো ওদের কথাগুলো। প্রাণপণে মাথা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতো চিন্তাটাকে, আর কদিন পরেই হিজাব করবো এই যুক্তিই নিজেকে দিতো সে বারবার। কিন্তু এখন করতে কী সমস্যা? এই প্রশ্নের জবাব কখনোই নিজের কাছে দেওয়া হয় নি।
সুযোগ আর সামর্থ্য একসাথে খুব কমই মেলে। হবু শ্বশুরবাড়িকে রাজি করানোর মত সুযোগ আর বুদ্ধি দুটোই মৌরিতার ছিল। রাশেদের পরিবার ওর কোন কথাটা রাখে নি? বিয়ের সময় যেমন যেমন কাপড়ের সেট আর গহনার ডিজাইন চেয়েছে, ঠিক সেগুলোই কিনেছে। হিজাবটা সে বিয়ের দিন করতে চাইলে সে সুযোগ নিশ্চয়ই ছিল। হয়তো একটু কাঠখড় পোড়াতে হতো, তাও তো চেষ্টা করে দেখতে দোষ ছিল না। এখন আর সেই দিনগুলো ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা নেই। সঠিক কাজটা করার সময় আগেই পার হয়ে গেছে। এখন তো প্রায় সব ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলোতেও সে হিজাব ছাড়াই চলে যায়। মানুষটা তার হিজাবের গুরুত্ব কীভাবেই বা বুঝবে? বন্ধু-বান্ধবীদের দেখাদেখি দু-চারটে ছবি মৌরিতা এখন সবার সাথে শেয়ার করে। সে সবে হিজাব নেই। এত শো-অফ করা তার ধাচে নেই, অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় সমানে-সমান কখনোই যেতে পারবে না জানে, তারপরও স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে কয়েকটা ভালো ছবি দেখাতে ইচ্ছে করে। রাশেদের খোঁচা দেওয়া কথাগুলোর সমস্ত ঝাল এখন নিজের ওপর ঝাড়তে ইচ্ছে করছে। দুঃখের ব্যাপার হলো, মানুষ নিজের ওপর রাগ ঝাড়তে পারে না।
দুঃখিনী মৌরিতা চোখে জল নিয়েই আয়নার সামনে সাজতে বসলো। মেয়েরা মনের জল গোপন করেও হাসতে পারে। আজ সন্ধ্যায় পার্টি। রাশেদের বসের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। মৌরিতা আজ হিজাব করলে রাশেদ কিছুতেই খুশি হবে না। অভ্যস্ত হাতে সব করে যাচ্ছে সে। অথচ মনটা ব্যথায় অবশ হয়ে আছে। সাড়ে তিন বছরের সংসার। রাশেদের জন্য সব করতে পারে মৌরিতা, তবু সে কি সুখী? সব ছেড়েও কি রাশেদের মন জয় করতে পেরেছে সে? রাশেদ কি তাকে একজন মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে শিখেছে?
কাজল, আইলাইনার, লিপস্টিক সব নিখুঁতভাবে হয়েছে। তার সাজার হাত চমৎকার। কিন্তু এত সেজেও কীসের যেন কমতি। আত্মগ্লানি, অনুশোচনা, লজ্জা, অপমান তাকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিচ্ছে। জানালা দিয়ে হু-হু একটা বাতাস এসে মৌরিতার আয়রন করা চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। চোখের জলে কাজল লেপটে একাকার হয়ে গেলো সাজানো চেহারা। কী মনে করে ধুম করে উঠে গেলো মৌরিতা।
মাথায় যেন কিচ্ছু নেই। একটা স্বর ভেসে ভেসে তাকে শুধু বলছে - ওয়াশরুম, ওয়াশরুম। রাশেদ খুশি হবে না জানে, তবু আজকে তাকে কাজটা করতেই হবে। বরং অনেক আগেই করা উচিত ছিল। আজ সে কোনো মেইক-আপ করবে না। পরিপূর্ণ হিজাব করবে। এখন থেকে সমস্ত অনুষ্ঠানেই সে পরিপূর্ণ হিজাব করবে। কক্ষণো আর হিজাব ছাড়ার মত ভুল করবে না। যার যা খুশি তাকে নিয়ে ভাবুক। এতদিন সংসারের জন্য অনেক করেছে, স্বামী-সংসারের বাহানা করে নিজের আত্মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর থেকে সরে গিয়েছে যোজন যোজন দূরত্বে। তাতে কোনো লাভ হয় নি। পাপের আনন্দ দুই দিনের, অনুতাপটা চিরকাল তাড়া করে ফেরে। মৌরিতার বুক চিরে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, হে আল্লাহ, অনেক ভুল করেছি। এবার আমাকে ক্ষমা করো, এবার আমায় পথ দেখাও…
কলের ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা আর চোখের উষ্ণ জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মৌরিতা, তুমি সুখী হও।
সংকলিত লেখা
লেখক এর লিঙ্ক এখানে
No comments:
Post a Comment
Plz spread this word to your friends