দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর

“আর কয়েকটা মাস মাত্র, তারপরই সালাত আদায় করা শুরু করবো। ব্যবসাটা একটু শক্তভাবে দাড় করিয়ে নেই, তারপর তাওবাহ করে হাজ্জ করে ফেলবো। একবার চাকরিটা হয়ে যাক। বিয়েটা হয়ে নিক, তারপর হিজাব করা শুরু করবো। কোন একটা ভালো অলটারনেটিভ পাই, পাওয়া মাত্রই ব্যাঙ্কের চাকরিটা ছেড়ে দেবো। আর কিছুদিন যাক, তারপর সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দেব। আরে একটু গানই তো শুনছি, কয়েকটা সিনেমাই তো দেখছি, কি আর হবে, বুড়ো কালে সব ছেড়ে দেবো। আর কিছু টাকা আয় করে নেই, তারপর দেশে ফিরে যাওয়া যাবে। প্রথমে সবাইকে দাড়ি আর হিজাবের ফযীলাত বোঝায়, আগে সবাইকে হুজুর বানাই তারপর শারীয়াহ কায়েমের দাওয়াহ দেয়া যাবে...”
.
এরকম শত চিন্তাভাবনা ক্রমাগত আমাদের মাথায় খেলে যায়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমরা কাঁটিয়ে দেই এই “তারপরের” আশায়। “আর একটু হলেই...” আর “তারপরের” পালা শেষ হয় না। কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসে। হিসাবের পাল্লা ভারী হতে থাকে, আর আমরা সময় কাঁটিয়ে দেই নিজেদের প্রবোধ দিয়ে, নিজের সাথে লুকোচুরি করে। “এই তো আর কিছুদিন, তারপরেই করবো...” নিজেদের জন্য বিভিন্ন ইমাজিনারি টার্গেট সেট করে, আল্লাহ্‌ ‘আযযা ওয়া জালের আদেশ পালনকে বিলম্বিত করি, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, টার্গেট আর ফুলফিলড হয় না। এক টার্গেটের পর আরেক টার্গেট আসে। এক সমস্যার পর আরেক সমস্যা আছে। সম্পূর্ণ ভাবে সবকিছু মনমতো গুছিয়ে নেয়া কখনোই সম্ভব না। আর তাই আল্লাহ-র আদেশ পালনও বিলম্বিত হতেই থাকে। ফুরিয়ে আসতে থাকে সময়।
.
কারো মনে কি আছে তা একমাত্র আল-খাবির, আশ-শাহীদ আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই ভালো জানেন। যা মুখে বলছে সেটা কি আসলেই অন্তরে আছে নাকি, মানুষের বুক চিড়ে সে খবর নেয়ার দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয় নই। আমরা মানুষকে বিচার করবো তার বাহ্যিক আচরণের ভিত্তিতে। তবে একথাও সত্যি, যদি কারো মনে কোন কিছুর একান্ত ইচ্ছা থাকে, তবে সেটার একটা বাহ্যিক প্রকাশ থাকে। কাজে ইচ্ছার সেই প্রতিফলন দেখা যায়। একটা উদাহরণ দেই।
.
আমরা জানি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পথে আল্লাহ্‌ রাসূলের ﷺ সঙ্গী ছিলেন আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। ইতিপূর্বে আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মডিনায় হিজরতের জন্য সব গোছগাছ করে একরকম রওনাই করে ফেলেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে অপেক্ষা করতে বলেন, কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ আশা করছিলেন, খুব শীঘ্রই আল্লাহ্‌ ‘আযযা ওয়াজাল তাঁকেও ﷺ হিজরতের অনুমতি দেবেন। শেষ পর্যন্ত যখন হিজরতের অনুমতি দেয়া হল, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন হঠাৎ এক ভরদুপুরে, মুখ ঢেকে আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বাসায় আসলেন, তখন দেখা গেল আবু বাকর রাদ্বীয়াল্লাহু আনহু সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। যদিও তিনি জানতেন না, ঠিক কোনদিন ডাক আসবে। শুধু তাই না, আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, শুধুমাত্র হিজরতের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট জাতের দুটো উটনী কিনে চার মাস ধরে বাবলা পাতা খাইয়ে তাদের হৃষ্টপুষ্ট করে তুলেছিলেন, যাতে করে মক্কা থেকে মদীনার দীর্ঘ যাত্রা সুচারু ভাবে সম্পন্ন হয়। [সূত্রঃ আর রাহীকুল মাখতুম]
.
.
এটা হল প্রস্তুতির আর অন্তরের ইচ্ছার বাহ্যিক প্রতিফলনের নমুনা। কিন্তু আমরা যখন নিজেদের জন্য বিভিন্ন টার্গেট সেটা করি – “এই হয়ে গেলেই, আল্লাহ্‌ এই আদেশ পালন করা শুরু করবো” – তখন কি আমাদের চিন্তা ও কাজের মাঝে এরকম মিল থাকে? এর দশভাগের এক ভাগও কি আমাদের মধ্যে দেখা যায়? উৎকৃষ্ট জাতের সবচেয়ে দামী উটনী না হয় বাদ দিলাম, আমরা কি বুড়ো-রুগ্ন একটা খচ্চর ও প্রস্তুত করি? বাবলা না হোক, ভাতের মাড়ও কি খাইয়ে প্রস্তুতি নেই? আমি যা বলছি, নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি, তার পেছনে কি আসলেই কোন সত্যতা আছে, কোন প্রকৃত সংকল্প ও তার বাস্তবায়ন আছে? না এ নিছক আত্বপ্রতারণা?
.
.
সাহাবাদের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া ইজমাইন, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম হবার অনেকগুলো কারণের একটি হল তাঁদের কথায় ও কাজে মিল ছিল। তারা নিজেদের জন্য ঠুনকো, মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করাতেন না। তাঁরা আত্বপ্রতারণা করতেন না, নিজেদের প্রবোধ দিতেন না। নিজেদের ভুল স্বীকারে এবং সংশোধনে তাঁরা ছিলেন অগ্রগামী। তাঁরা দুনিয়ার উপর দ্বীনকে শর্তাধীন করেননি। এই দুনিয়াবি লক্ষ্য অর্জনের উপর দ্বীনের হুকুম পালন করা না করাকে নির্ভরশীল করেন নি। দুনিয়ার মাপকাঠি অনুযায়ী দ্বীনকে পরিমাপ করেন নি। দুনিয়া; সমাজ, পারিপারিপার্শ্বিকতা, প্রিযমের ভেতর দিয়ে তাঁরা ইসলামকে দেখেন নি। বরং দ্বীনের মাপকাঠিতে তাঁরা দুনিয়াকে দেখেছেন। আগে দ্বীনকে রেখেছেন, দুনিয়াকে তুচ্ছ করেছেন। আর তাই আল্লাহ্‌ ‘আযযা ওয়া জাল তাঁদেরকে দ্বীন ও দুনিয়া দুটোতেই সম্মানিত করেছেন। রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া ইজমাইন।
.
সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া ইজমাইনের জন্য ইসলামই ছিল একমাত্র মাপকাঠি। তাঁরা প্রথমে রেখেছিলেন ইসলামকে, বাকি সব কিছুকে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিচার করেছিলেন। বাকি সব কিছুকে তাঁরা ইসলামের মুখাপেক্ষী করেছিলেন, ইসলাম পালনকে কোন কিছুর মুখাপেক্ষ করেন নি- শর্তাধীন করেন নি। ইসলামে যা সুস্পষ্ট তা সুস্পষ্ট ভাবেই প্রচার করেছিলেন, পালন করেছিলেন। দ্বীনের কিছু অংশ গ্রহণ আর কিছু অংশ ছেড়ে দেন নি। নিজের সুবিধা অনুযায়ী অজুহাত তৈরি করেন নি। নিজেকে তাঁরা যাচাই করতেন দ্বীনের মাপকাঠিতে, নিজের মাপকাঠিতে দ্বীনকে তাঁরা যাচাই করেন নি। আর নিজেদের হিসেব গ্রহনে তাঁরা ছিলেন নিজেদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর। সত্যিই যদি আমরা চাই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনুসরণ করতে, দ্বীন ইসলামে প্রকৃত ভাবে প্রবেশ করতে এবং এ দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে, তবে সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া ইজমাইনের মতো করে দ্বীন ও দুনিয়াকে বুঝতে হবে। তাঁদের মতো করে পৃথিবীকে দেখতে হবে। আর কোন বিকল্প আমাদের হাতে নেই।
.
".... এবং এই উম্মাহ’র শেষ অংশ কখনও ততক্ষন পর্যন্ত পরিশুদ্ধ হবে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা এই উম্মার প্রথম অংশ (সাহাবা) যা দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়েছিলেন তার দ্বারা পরিশুদ্ধ হয়।" ..
ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ
.collected
‪#‎KnowYourHeroes‬
‪#‎AbuBakrRA‬

No comments:

Post a Comment

Plz spread this word to your friends