অলস মুহূর্ত, বিন্দু বিন্দু রক্ত!

প্রায় ছয় বছর আগের কথা। আমার নতুন ঝকঝকে বাসায় হঠাত একটি তেলাপোকা দেখতে পেলাম, পিচ্চি সাইজের। আমি এই জিনিসটা খুব ভয় পাই। আমার বাসায় ছিলও না। এলো কি করে তা ভাবতে লাগলাম। তখন মনে পড়লো, দুদিন আগে এক ভদ্রলোকের বাসা থেকে কিছু ইলেকট্রনিক্স এনেছিলাম, তিনি দেশে চলে যাচ্ছেন, বলেছিলেন ওগুলো নিয়ে যেতে। তখন মাত্র সৌদি আরবে এসে বাসা নিয়েছি, জিনিসগুলো আমারও প্রয়োজন ছিল। তাঁর বাসায় প্রচুর তেলাপোকা দেখেছিলাম। হয়তবা সেখান থেকেই চলে এসেছে! এসব বিষয়ে অনভিজ্ঞ আমি ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলাম। এসেছে, চলে যাবে! তার বেশ কিছুদিন পর একদিন রাতে ঘুম ভেঙে পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে হাত পা ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল! শ'খানিক তেলাপোকা রান্নাঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে!!! এরা কখন এলো, এতগুলো কিভাবে হল???! সেই একই ভয় আবারও পেয়েছিলাম এ বছরের শুরুতে, যখন একের পর এক ঘটনা ঘটে চলছিল! একজন নাস্তিকের মৃত্যু থেকে তার সূচনা। সেই একই প্রশ্ন মনে এসেছিল-- এই সব কখন হল, কিভাবেই বা?! উত্তরটাও হয়ত একই। আমার ঘটনা শুনে এক ভাবী যেটা বলেছিলেন। "এই জিনিস একটাকেও যদি ফেলে রাখা হয়, হাজারটা গজাবে!"

প্রতিটা অনাচার যখন আমরা অপ্রতিবাদে ফেলে রাখি, ভাবি যে ও আর এমন কি, তখন সেই সামান্য অনাচার একসময় বিশাল এক আগুন হয়ে ওঠে! ওতে পুড়তে থাকে আমাদের নিজেদেরই কেউ না কেউ! এই নাস্তিক, এদের অনুসারী, মানুষের মনের এত ভুল ধারণা, ইসলাম নিয়ে এত ভয় ভীতি-- একদিনে হয়নি! কিন্তু, যতদিনেই হোক, সেই দিনগুলোতে আমরা নিজেরা কি করেছি??? উত্তর আছে কি, আমাদের কাছে??!

ছোটবেলায় দোয়ার বই ঘাঁটলে প্রায়ই দেখতে পেতাম অলসতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলা হচ্ছে। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর লাগত। আমি অলস। কিন্তু এতে তো কোথাও কোনও সমস্যা হচ্ছে না! কী এমন জিনিস এটা, যে অন্যান্য বিপদ আপদ, বার্ধক্য, ঋণ, এসবের থেকে আশ্রয় চাওয়ার সময় অলসতার কথাটাও যোগ করা হয়েছে? দুর্বল ঈমান নিয়ে এটুকু বুঝতে পারিনি যে, বলা যখন হয়েছে, এটা সেই পর্যায়ের সমস্যা!!! প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করলাম যখন আবিষ্কার করলাম আমি সংসারের কাজ সামলে উঠতে পারছি না! কারণ খুঁড়তে যেয়ে বের হল, প্রায়ই সময় থাকতে একটা কাজ করে ফেলি না। তাই পরে কাজ জমে যায়। আর তখন মনের ওপর সেটা চাপ সৃষ্টি করে! আমিও তখন দোয়া করা শুরু করলাম। কিন্তু আসলে যে অলসতা কি ভয়াবহ সমস্যা, সেটাও টের পেয়েছিলাম এ'বছর দেশে চলতে থাকা সেই গণ্ডগোলের সময়! কিভাবে?? বলছি, তার আগে একটি চিঠির কথা বলি!

মেয়েকে নিয়ে সিরিয়ার মুসলিমদের ওপর চলা অত্যাচারের ভিডিও দেখছিলাম দু বছর আগে। দেখছিলাম বলাটাও ভুল, শুনছিলাম। চোখে তো সবকিছু ঝাপসা দেখা যাচ্ছিলো-- চোখ তখনো কাঁদতে জানত, তাই! একজন অল্পবয়সী যুবক খুন হওয়ার আগে একটি চিঠি লিখেছিল, সেটাও দেখানো হয়েছে সেই ডকুমেন্ট্রিতে। সেখানে সে বলেছিল, তোমরা যারা বেঁচে আছ, "লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ" কে আঁকড়ে ধরে বাঁচো! আমার তখন নিজের জীবনটার দিকে তাকিয়ে বড় লজ্জা হয়েছিলো। আমাদের ভাইয়েরা মরতে জানে, সে নিয়ে আমরা কাঁদতে জানি। কিন্তু জীবনটা আমাদের এমন উদ্দেশ্যহীনভাবে পার হচ্ছে কেন?? প্রশ্নটা আবার মনে আসে যখন একে একে নাস্তিকদের নাম উঠে এলো তখন। মনে আসে যখন তাদের অনুসারীদের সংখ্যা দেখি তখন। মনে আসে যখন রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষের প্রাণনাশের কথা শুনা যায়, তখন! মনে আসে যখন কেউ সাহস করে বলে যে একজন মেয়ে নিকাব দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারবে না, তখন। আমরা কী করছি?? কোথায় চলেছি???

আর তখনই বুঝি, অলসতার থেকে কেন আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে! আমাদের প্রতি মুহূর্তের অলসতা, প্রতিটি মুহূর্তকে "গলা টিপে" মেরে ফেলা-- আড্ডায়, অযথা ঘোরাঘুরিতে, অযথা কাজে-- এসব আমরা ফ্রিতে পাচ্ছি না! পাচ্ছি কোথাও না কোথাও আমাদের কোনও না কোনও ভাইয়ের শরীরের প্রতিটি ফোঁটা রক্তবিন্দুর বিনিময়ে!! পাচ্ছি কোথাও না কোথাও আমাদের অসতর্কতার সুযোগ নেয়া কোনও নাস্তিকের খপ্পরে পড়ে ঈমান হারানো আমাদেরই কোনও ছেলের বিনিময়ে! পাচ্ছি কোথাও না কোথাও আমাদেরই কোন বোনের হিজাব খুলতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় নামক জায়গাটাকে জীবন থেকে বাদ দেয়ার বিনিময়ে!!! বিনামূল্যে পাই না আমরা এই অলস মুহূর্তগুলো! না, পাইনা বিনামূল্যে!! 

অনেক, অনেক নির্ঘুম রাত কেটেছে অনেকের মত আমারও-- "কী করবো??" ভেবে। এত ময়লা চারিদিকে, কিভাবে পরিষ্কার করবো?? কোথা থেকে শুরু করবো??? চোখে ভেসে উঠলো আমার নিজেরই চেহারা। বাসে করে যখন উমরায় যেতাম, গজগজ করতাম প্রতিটা স্টপেজে! প্রত্যেকে যদি কেবল নিজে পরিষ্কার থাকতো, বাথরুম, অজুর জায়গা কোনদিন এত নোংরা হত না! এ তো নিজে নিজে নোংরা হয়নি, কেউ না কেউ নোংরা করে ফেলে রেখে যাচ্ছে বলেই এমন হচ্ছে!! হ্যাঁ, নিজে! নিজের গুনাহে লিপ্ত হওয়া থামাতে হবে! নিজেকে শুদ্ধ করতে হবে! সারারাত মুসলিম উম্মাহর কথা ভেবে ফজর মিস করা টাইপের ময়লা পরিষ্কারের কাজ করে কোনও লাভ নেই!

মদীনায় রমজান মাসের অনেকটুকু কেটেছিল এবার, আলহামদুলিল্লাহ। প্রায় ২০ পারার মত তিলাওয়াত শোনার তৌফিক হয়েছিলো। কই, শুনে তো মনে হয়নি আল্লাহ এমন এক জাতির ওপর বিশ্বাস রাখেন, যারা হেরে যেতে শিখেছে? এরা সমস্যার ব্যাপকতা দেখে হেরে যেতে শেখেনি, এরা শত্রুর সংখ্যা দেখে পিছিয়ে পড়তে শেখেনি! একজনকে অন্যায়ভাবে মেরে ফেললে আরও হাজারজন ঈমান এনেছে আল্লাহর ওপর! আমরা কি নিজেদের মুসলিম বলি না?? তাহলে কেন আমরা হেরে যাবো?? কেন কাটবে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত উদ্দেশ্যহীন? কেন আমরা প্রতিটা মুহূর্ত "কাটিয়ে" দিবো আর সবার মত-- কিন্তু আঁকড়ে ধরবো না, শিখতে, শেখাতে?! জানার জন্য ব্যয় করবো না কেন প্রতিটি বাড়তি মুহূর্ত? জানবো না কেন আমাদের ইতিহাস, আমাদের দায়িত্ব, আমাদের জীবনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য?

ঘুমিয়ে পড়ার জন্য, ঝিমিয়ে পড়ার জন্য মুসলিমদের জন্ম হয়নি! তাই আজ ঘুমিয়ে থেকে, ঘুম ভেঙে কোলাহল দেখে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটলে চলবে না! যেহেতু আমরা বেঁচে আছি, আমাদের জন্য কিছু একটা করার সুযোগ এখনো আছে! আসুন আমরা অলসতায় সময়গুলোকে না কাটিয়ে এমন কিছু করি যা নিয়ে আমরা আল্লাহর সামনে আশার সাথে দাঁড়াতে পারি! আমরা কুরআন শিখতে পারি, তাফসীর জানতে পারি। নিজেদের আকিদা ঠিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে পারি! ঠিক করতে পারি নিজেদের ছোট ছোট বদঅভ্যাস! নিজেদের জীবনে নিয়ে আসতে পারি ছোট ছোট সেই ভালো কাজগুলো যা আল্লাহর রাসুল (সা) তাঁর ব্যস্ত জীবনের মাঝেও আঁকড়ে ধরে ছিলেন!

যখনই মন চাইবে অলসতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে, অলস দিন কাটাতে, আমরা যেন মনে রাখি, এর বিনিময়ে গোটা মুসলিম উম্মাহর রক্তক্ষরণ হচ্ছে! ঘুমিয়ে দিন পার করতে এই পৃথিবীতে মুসলিমরা আসেনি! জীবনের লক্ষ্য জীবন পার করে দেয়া না! আমরাও জীবন পার করবো না এভাবে উদ্দেশ্যহীন ভাবে, কর্মহীন অলসতায়, অজ্ঞতায় আর অপারগতায়! ঘুমিয়ে থাকবো না! ইনশাআল্লাহ!

No comments:

Post a Comment

Plz spread this word to your friends