ভুমিকা ঃ দ্বীনি বাবা-মা তথা দ্বীনি পরিবার আল্লাহ তায়ালার অন্যতম বিশেষ নেয়ামত গুলোর একটি।পরিবার ইসলাম সচেতন না অথচ আল্লাহর রহমতে কোন সন্তান যদি দ্বীনের পথে চলে আসে তবে সেই সন্তান হারে হারে টের পায় এই ঘাটতির ফল।
ছোটবেলায় আমি যখন অমুসলিম ছিলাম, প্রথম প্রথম মুসলিমদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা ছিল না। তাদের সম্পর্কে জানা প্রথম তথ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল যে তারা শুকরের মাংস খায় না। এটা খাওয়া নাকি “হারাম”। হারাম শব্দটাও এই শুকর দিয়েই শেখা।
তখন আমি খুব ছোট। বাসার কাজে সাহায্যকারী মেয়েটি ছিল আমাদের দুই বোনের খেলার সাথী। ওর কাছেই প্রথম শুনেছিলাম হিন্দুরা যেমন গরু খায় না, মুসলিমরা শুকরের মাংস খায় না। পরবর্তীতে স্কুলের মুসলিম সহপাঠী থেকে শুরু করে চেনাজানা অন্যান্য মুসলিমদের কাছে জেনেছিলাম যে শুকর নামের প্রানীটা এতটাই “হারাম”, যে এর নাম পর্যন্ত মুখে নেয়া যায় না! অথবা এর নাম শুনলে বা ছবি দেখলেও নাকি ঘেন্না লাগে। এমন কি, আমাদের অমুসলিম কারো বাসায় এই জিনিস রান্না করলে তার একটা কোড নেইম ব্যবহার হতো।
বড় হয়ে যখন আল্লাহ আমাকে মুসলিম বানিয়ে দিলেন, জানলাম হারাম শুধু শুকরের মাংস না - হারাম হচ্ছে মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, সুদ-ঘুষের আদান-প্রদান, গান-বাজনা, অমুসলিমদের উৎসবে যোগদান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বেপর্দা থাকা, ফরয ইবাদাত না করা ইত্যাদি ইত্যাদি...।
অদ্ভুত লেগেছিল ব্যাপারটা!
চারপাশের মুসলিমরা সব নিষিদ্ধ কাজই দেদারসে করে বেড়াচ্ছে, অথচ শুকরের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে তারা মহা কট্টর। হাজারটা হারামে ডুবে থাকা ব্যক্তি যত যাই করুক, শুকর ছোঁবে না কিছুতেই।
কেন এমন হলো?
শিশুবেলায় পরিবার আর চারপাশের পরিবেশ আমাদের একমাত্র শিক্ষাক্ষেত্র। এখানে আমরা তাই শিখি যা আমরা দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে বড় হই। আমরা কী ধরনের মুসলিম হব তা নির্ভর করে পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার উপর। শুকরের ব্যাপারটাও তাই। আমাদের ইসলামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শেখানো হোক আর না হোক - এই ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বের সাথে শেখানো হয়। আর তাই আমরা গুরুত্বের সাথেই তা মেনে চলি।
কেমন করে?
বাচ্চাদের ছোট থেকেই জানানো হয় যে এই বিশেষ প্রানীর মাংস হিন্দু-খ্রিস্টানরা খায়, আমরা খাই না। মদ, ঘুষ, সুদ ইত্যাদি হারাম বিষয় বড়রা নিজেরাই করে বেড়াচ্ছে, কাজেই এসব নিষেধাজ্ঞা শেখানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তাই হারাম বলতে ওরা শুধু ওই একটা জিনিসই বোঝে।
এটা ঠিক যে শুকর আল্লাহ হারাম করেছেন। সেই সাথে অন্য অনেক কিছু হারাম করেছেন যেগুলো আমাদের জানানো হয় না বা জেনেও মানতে চাই না। আমাদের কাছে ইসলাম বলতে শুকর না খাওয়া, দলীলবিহীন কিছু প্রথা মানা আর কিছু অহেতুক আবেগ প্রকাশের মাঝে সীমাবদ্ধ।
আমাদের অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে ইসলামের মৌলিক বিধিনিষেধগুলো মানি আর না মানি, কিছু কিছু বিষয়ে আমরা কিন্তু সেইরকম প্র্যাক্টিসিং! আমাদের মেয়েরা সারাজীবন খোলামেলা থেকেও শুধু আযানের সময় বা ইফতারের সময় মাথা ঢাকতে ভুলে না। আমাদের কুরআনের মুসহাফটা কাপড়ে জড়িয়ে উঁচু স্থানে তুলে রাখা হয়, ধুলিমলিন কিতাবটা শুধু রমাদানেই “খতম” দেয়ার উদ্দেশ্যে হাতে নেয়া হয়। আমরা নিয়মিত সলাত আদায় করলেও সলাতে কী বলছি না বলছি কিছুই বুঝি না। উচ্চারণেও থাকে শত ভুল। আমরা এখন পর্দা করা বলতে বুঝি মাথায় বাধাকপির ন্যায় পট্টি বেঁধে মুখে রং মেখে সং সাজা। সোশাল মিডিয়ায় আমরা অদ্ভুত অদ্ভুত “ইসলামিক” তথ্য শেয়ার দিতে থাকি, কোথাও আমীন না বলে যাই না।
মানবশিশুর মস্তিষ্কে শিশুকালেই যে তথ্যগুলো দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেয়া হয়, সাধারণত সারাজীবন তা মেনে চলে সে। মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে থাকে তা।
একটা মেয়ে যখন এটা দেখতে দেখতে বড় হয় যে টিভিতে মহা আগ্রহে সবাই অভিনেত্রী, গায়িকা আর মডেলদের দেখছে; তাদের রূপের প্রশংসা করছে; তাদের জীবন নিয়ে আলোচনা করছে - স্বাভাবিকভাবেই সে ওই দিকে আকৃষ্ট হয়। নিজেকে ওই অবস্থানে কল্পনা করে। ওই সস্তা মেয়েগুলোকে তখন ওর সবচাইতে দামী বলে মনে হতে থাকে। মাথা, ঘাড়, ঠোঁট বেঁকিয়ে অপ্রকৃতস্থের মতো পোজ দিয়ে সেল্ফি তুলে আপলোড করে সে। কিছু সস্তা লাইকে আবেগে আপ্লুত হয়। ইসলাম থেকে সরে যায় যোজন যোজন দূরে।
একটা ছেলে তার ক্লিন শেইভড বাবা, ধূমপায়ী চাচা, সুদি ব্যাংকে চাকুরীরত মামা অথবা প্রেমিক বড় ভাইকে দেখে কখনোই শিখবে না ইসলামে এসবের বিধান কী।
আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন, নিয়মিত কুরআন পড়েন, হজ্জটাও সেড়ে ফেলেছেন। অথচ বাসায় হুজুর রেখে ভেবে নিয়েছেন সন্তানদের ইসলাম শেখানোর দায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন।
আসলে তা নয় বোন। ইসলাম মানে শুধু সলাত সিয়াম নয়। ইসলাম মানে আল্লাহ প্রদত্ত প্রত্যেকটা বিধিনিষেধ মেনে চলা, শিশুকাল থেকেই তাদের মনে সঠিক ইসলামকে গেঁথে দেয়া। তাকে তার রবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আপনার। এই দায়িত্বে অবহেলা করলে প্রতিফল একদিন আপনাকেই পেতে হবে।
ভাই, আপনি যদি এখনই মেয়েকে পর্দা করতে না শেখান, ভবিষ্যতে “দায়্যুস” হিসেবে গণ্য হবেন। দায়্যুসের জন্য জান্নাত হারাম। শুধু আদেশ না দিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন। রবকে ভালোবাসতে শেখান, তাহলে রবের দেয়া বিধান আপনাতেই মেনে নেবে সে।
যদি আপনি নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবী করেন, তাহলে সবার আগে নিজে সঠিক ইসলামকে জানুন। কুরআনের অর্থের অনুবাদ পড়ুন। আজকাল ইসলাম শেখার জন্য রিসোর্সের অভাব নেই। আপনি শিখুন, নিজের জীবনে মেনে চলুন। সন্তানের জন্য নিজেকে রোল মডেল হিসেবে তৈরি করুন। ইনশাআল্লাহ্ তারা শুধু শুকর হারাম ছাড়াও আরো অনেক কিছুই শিখে ফেলবে।