উত্তম ঘরের চাবিকাঠি সিরিজ: ২য় পর্ব


.
::ঘরকে উত্তম বানানোর উপায়::
.
নিচের এ পয়েন্টগুলো থেকে আল্লাহ তা’আলা আমাদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ দিক যাতে আমরা আমাদের ঘরগুলোকে প্রকৃত মুসলিমের ঘর তথা উত্তম ঘরে পরিণত করতে পারি।
.
#পরিবার_গঠন
.
১। উত্তম জীবনসঙ্গী বাছাই:
আল্লাহ বলেন, "তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।" (সুরা নূর:৩২)
.
উত্তম জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের কীভাবে করবেন? আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেন,
.
“চারটি জিনিস দেখে কোনো নারীকে বিয়ে করা যায়- সম্পদ, বংশ, রূপ বা দ্বীন। বাছাই করো যে দ্বীনদার কাউকে নইলে তোমার হাত ধুলি ধূসরিত হোক। (বুখারী ও মুসলিম)
.
“এই দুনিয়ার সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী সম্পদ। কিন্তু এ জীবনের সবচেয়ে আনন্দের হলো একজন নেককার স্ত্রী।” (মুসলিম: ১৪৬৮)
.
“তোমাদের সবার শোকরগোজার অন্তর, যিকিরকারী জিহ্বা ও বিশ্বাসী স্ত্রী থাকুক যে পরকালীন সফলতা অর্জনে সাহায্য করবে।” (আহমাদ: ৫/২৮২, তিরমিজী ও ইবন মাজাহ)
.
রাসুলুল্লাহ ﷺ আরও বলেন,
“কারও জন্য সর্বোত্তম সম্পদ হলো নেককার স্ত্রী যে দুনিয়া ও দ্বীনে তোমাকে সাহায্য করবে।” (বায়হাকী: সাহীহুল জামি,৪২৮৫)
.
"প্রেমময়ী ও অধিক সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারীকে বিয়ে করো। কারণ, আমি কিয়ামতের দিন অন্য নবীদের সামনে তোমাদের সংখ্যার বিশালতা নিয়ে গর্ববোধ করবো।" (আহমাদ: সহীহুল ইরওয়া, ৬/১৯৫)
.
"আমি তোমাদের কুমারী নারীকে বিয়ে করার উপদেশ দিচ্ছি কেননা, তাদের গর্ভ নবীন, তাদের মুখ (কথা) মিষ্টি, আর তারা অল্পতে বেশি তুষ্ট" অন্য বর্ণনায় "...তারা ছলনাময়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম।" (ইবন মাজাহ, ৬২৩)
.
একজন নেককার নারী যেমন চারটে সুখকর ব্যাপারের একটি, একজন পাপাচারী নারী তেমন চারটে দুঃখবাহী ব্যাপারের একটি। রাসুলুল্লাহ ﷺ সহীহ হাদিসে বলেন, "সুখের অন্যতম (উপাদান) হলো একজন নেককার স্ত্রী। যখন তুমি তার দিকে তাকাও তোমার মন প্রশান্ত হয়ে যায়, আর যখন তুমি বাইরে যাবে তুমি তার ও তোমার সম্পদের ব্যাপারে তার উপর আস্থা রাখতে পারো। আর দুঃখের অন্যতম (উপাদান) হলো পাপাচারী স্ত্রী যার দিকে তাকালে তোমার মন বিচলিত হয় আর সে তোমাকে মুখ দ্বারা আক্রমণ করে। আর যখন তুমি বাইরে যাও তাকে তার ও তোমার সম্পদের ব্যাপারে আস্থাশীল পাও না।"
.
অন্যদিকে নারীদেরও বিয়ের প্রস্তাবদানকারী পুরুষটি সম্পর্কেও একইভাবে জানার ব্যাপার আছে তার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার আগে।
.
আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেন, "তোমাদের কাছে যদি এমন কেউ আসে যার দ্বীন ও চরিত্রের ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট তবে নিজের মেয়েকে (বা বোনকে ইত্যাদি) তার কাছে বিয়ে দিয়ে দাও। অন্যথায় দুনিয়ায় ফিতনা ও ব্যাপক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে।"
.
ঘর যাতে না ভাঙে বা না ক্ষতির সম্মুখীন হয় সেজন্য সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, সত্য যাচাই, তথ্য সংগ্রহ ও এর উৎস তালাশ করে উপরের এগুলো অর্জন করা আশু দরকারী।
.
নেককার নারী ও নেককার পুরুষ মিলে ঘরটাকে পূণ্যময় করতে পারে কেননা, "...উৎকৃষ্ট ভূমি তার প্রতিপালকের নির্দেশে ফসল উৎপন্ন করে আর যা নিকৃষ্ট তাতে কঠোর পরিশ্রম ব্যাতীত কিছুই জন্মায় না..." (সুরা আল-আরাফ:৫৮)
.
২। স্ত্রী/স্বামীকে সঠিক পথে আনার প্রচেষ্টা:
কারও স্ত্রী/স্বামী যদি নেককার হন তবে তা অবশ্যই সৌভাগ্যের। তবে অন্যথাও হতে পারে যখন কেউ নিজেই প্রথমে নেককার ছিলেন না বা ছিলেন কিন্তু পরে ঠিক করে নেওয়ার লক্ষ্যে কিংবা বাবা-মা, আত্মীয়দের চাপে বিয়ে করেন। এমতাবস্থায় কারও জন্য তার স্পাউজকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা একেবারে আবশ্যক। পুরুষের ক্ষেত্রে ঘরের কর্তা হিসেবে আবার তা তার আবশ্যিক দায়িত্বও। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে হেদায়েত আল্লাহর কাছ থেকেই আসে।
.
স্ত্রী/স্বামীকে সঠিক পথে আনার উদ্দেশ্যে যা করা যেতে পারে-
* স্ত্রী/স্বামীর আল্লাহর 'ইবাদাতের ক্ষেত্রে নির্ভুলতা নিশ্চিত করা
* তার ঈমান শক্তিশালী করতে আপনার প্রচেষ্টা যেমন-
- তাহাজ্জুদের নামাজে উৎসাহ প্রদান
- কুর'আন পড়তে উৎসাহ প্রদান
- যিকির-আজকার মুখস্ত ও সঠিক সময় তা পাঠে উৎসাহ প্রদান
- দান-সাদাকায় উৎসাহ প্রদান
- উপকারী ইসলামী বই পড়তে উৎসাহ প্রদান
- উপকারী ইসলামী অডিও শুনতে উৎসাহ প্রদান (যা তার জ্ঞান ও ইমানকে মজবুত করবে) ও তার সরবরাহ চালিয়ে যাওয়া
- তার জন্য উত্তম, দ্বীনদার বন্ধু বাছাই করে দেওয়া
- সকল খারাবীর প্রবেশদ্বার তার জন্য রুদ্ধ করে দেওয়া
- ঘরে আস্থাশীল ও বিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করা
.
৩। ঘরকে আল্লাহর স্মরণের জন্য উপযুক্ত করে নেওয়া:
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, "যে ঘরে আল্লাহর স্মরণ হয় আর যে ঘরে আল্লাহর স্মরণ হয় না এদের উদাহরণ যথাক্রমে জীবিত আর মৃতের।"
.
আজকাল মুসলিমদের ঘরগুলো হয়ে গেছে গীবত-পরনিন্দা, শয়তানের গান-বাদ্যের কেন্দ্র কিংবা গায়র মাহরামদের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ। এমন ঘরে রহমতের ফেরেশতা আসে না।
.
আমাদের ঘরগুলো কুর'আন পাঠ, ইসলামী আলোচনা আর বিভিন্ন ইসলামী বই পড়ার স্থান বানিয়ে নেওয়া আশু জরুরী।
.
৪। ঘরকে 'ইবাদাতের স্থান বানানো:
আল্লাহ তা'আলা মুসা (আলাইহিসসালাম) ও তাঁর ভাইকে বলেছিলেন তাদের আবাসস্থলে সালাত আদায় করার ও মুমিনদের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য। আল্লাহ আমাদের জন্য বলেন, "হে মু'মিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।" (সুরা বাকারা: ১৫৩) রাসুলুল্লাহ ﷺ কোনো দুঃখ-কষ্টের বিপরীতে সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। সাহাবারা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) ফারদ(ফরজ) নামাজ ছাড়া বাকি নামাজ ঘরে পড়তেন। সুতরাং ঘরে নামাজ আদায় করা অত্যন্ত জরুরী। তাছাড়া সন্তানদের ছোট থেকে নামাজে আগ্রহ বাড়াতে ও অভ্যস্ত করে তুলতে সুন্নাহ ও নফল নামাজগুলো ঘরেই পড়া উত্তম।
.
৫। পরিবারের সবার জন্য আত্মিক প্রশিক্ষণ:
আ'ঈশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, "আল্লাহর রাসুল ﷺ ঘরে রাতের নামাজ (ক্বিয়ামুল লাইল) আদায় করতেন আর তাঁর বিতরের নামাজের সময় হলে বলতেন, "হে আ'ঈশা! উঠো। বিতর পড়ে নাও।" (মুসলিম: ৬/২৩)
.
রাসুলুল্লাহ ﷺ আরও বলেন, "আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুক যে রাতে জাগ্রত হয় আর নামাজ আদায় করে আর এরপর সে তার স্ত্রীকে জাগায় নামাজের জন্য। এরপর যদি সে উঠতে না চায় তবে তার মুখ পানির ছিটা দেয়।" (আহমাদ ও আবু দাঊদ)
.
নারীদের দান-সাদাকায় উৎসাহিত করাও ঘরে আত্মিক প্রশিক্ষণের একটা উপায়। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, "হে নারীগণ! তোমরা বেশি বেশি দান-সাদাকা করো। কেননা, জাহান্নামের বাসিন্দাদের মধ্যে নারীরাই বেশি বলে আমি দেখেছি।" (বুখারী: ১/৪০৫)
দান-সাদাকার জন্যে ঘরে একটা আলাদা বক্স রাখা যেতে পারে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো রোজা রাখা- আইয়ামে বীজ (প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ), শাওয়ালের ছয় রোজা, আশুরা (মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ), 'আরাফা, আর মুহাররম ও শাবানে বিভিন্ন সময় রোজা রাখা।
.
৬। সুন্নাহ অনুযায়ী ঘরের দু'আ ও যিকিরের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া:
*ঘরে প্রবেশের দু'আ-
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, যখন তোমাদের কেউ ঘরে প্রবেশ করে আর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে যখন সে প্রবেশ করে ও খায়, শয়তান বলে, 'তোমার এখানে থাকার বা খাওয়ার কোনকিছু নেই'। তবে যদি সে ঘরে ঢুকতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করে, শয়তান বলে, 'তোমার এখানে থাকার জায়গা হলো'। যখন সে খাওয়ার সময় আল্লাহর নাম না নেয়, শয়তান তখন বলে, 'তোমার এখানে থাকা-খাওয়ার জায়গা হলো।' " (আহমাদ ও মুসলিম)
.
ঘর থেকে বের হওয়ার দু'আ হলো- বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু 'আলাল্লাহ। লা হাওলা ওয়ালা ক্কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। (আবু দাঊদ ও তিরমিজি)
.
*সিওয়াক-
আ'ঈশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, "রাসুলুল্লাহ ﷺ ঘরে ঢুকে প্রথমেই যে কাজটি করতেন তা হলো মিসওয়াক করা।" (মুসলিম)
.
৭। শয়তানকে তাড়িয়ে দিতে ঘরে নিয়মিত সুরা বাকারাহ তিলাওয়াত করা:
আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেন, "তোমরা তোমাদের ঘরকে কবর বানিয়ে ফেলো না। যে ঘরে সুরা বাকারাহ তিলাওয়াত করা হয় সে ঘরে শয়তান থাকে না।" (মুসলিম ১/৫৩৯)
.
(চলবে ইনশাআল্লাহ...)
.
সহায়ক গ্রন্থ: ঘরের জন্য ৪০ উপদেশ (শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ)
.
#UttomGhorerChabikathi
#HujurHoye

No comments:

Post a Comment

Plz spread this word to your friends